:: স্বাতী চৌধুরী ::
তিনজন মধ্যবয়সী নারী একটি প্ল্যাটফরমের নিরিবিলি স্থানে বসে লতা কুটছিল। তাদের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মনে হচ্ছিল একই পরিবারের লোক। মনে হচ্ছিল সঙ্গে বাড়ি সঙ্গে ঘর এইরকম কোন পরিবারের বাসিন্দা এরা। বাড়ি কোখায় জিজ্ঞেস করাতেও তারা এরকমই একটা উত্তর দেয়। তারা হাসে। প্রাণখোলা হাসি। হাসতে হাসতেই জানায় তারা এক পরিবারের লোক নয়। এমন কি কোন চেনা-জানাও ছিল না কিছুদিন আগে পর্যন্ত। এই স্টেশনেই পরিচয় হয়েছে তাদের। তারপর গত কয়েকমাসে পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিয়েছে আর যেন বাধা পড়েছে আত্মীয়তার বাঁধনে। কিন্তু এখন আর তারা ভাবতেও পারেনা যে কেউ কারো আপন নয়।
আখাউড়া রেল স্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্মে এই আলাপচারিতা চলছিল। বিকেল সাড়ে তিনটা বাজে তখন। পশ্চিম আকাশ বেয়ে গনগনে হলুদ রঙের রোদ বেয়ে পড়ে তাতিয়ে দিচ্ছে প্ল্যাটফর্মের মেঝে, রেললাইন, ঘাস লতাপাতা, বুনো ফুলের গাছ। সাধারণত এই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামার ঘোষণা না শোনা পর্যন্ত আগে থেকে এখানে দাঁড়িয়ে কেউ জটলা পাকায় না। এই সময় সিলেট থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা এবং চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কর্ণফুলি কমিউটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীরা এক নম্বর এবং দুই নম্বর প্লাটফর্মে ভিড় করে দাঁড়ায়। সেই তুলনায় তিন নম্বর বেশ নিরিবিলি থেকে গনগনে রোদের তাপে ঝিমায়। তার সাথে নিরিবিলি প্রত্যাশী কিছু যাত্রী সাধারণ যারা ঠিক জানে না কখন কোন প্ল্যাটফর্মে তার ট্রেন আসবে তারা আগেভাগে এসে এখানে বসে ঝিমায়। ফাতেমা বেগম এদেরই একজন। কসবার খাড়েরা তার ঘর। এখানে আখাউড়ার কাছে কুটুমবাড়িতে মাঝে মাঝেই আসতে হয় তাকে। একটি লোকাল ট্রেনের অপেক্ষায় সে তিন নম্বরে বসে থাকে। এই আসা-যাওয়া ও বসে থাকার ফাঁকে পরিচয় নসিরন বেওয়ার সাথে। এই তিন নম্বরের কোণায় কানায় ঘরবাড়িহীন ভাসমান কিছু মানুষেরাও নিরিবিলি সময় যাপন করে। সেরকমই একজন নসিরন বেওয়া। তার নির্দিষ্ট কোন কাজ কর্ম নেই। যখন যা পায় বা যখন যা মনে চায় তাই করে। যে ছেলেদের অনেক কষ্টে বড় করেছিল তাদের পাখনা গজাতেই ফেলে চলে গেছে। এখন বলতে গেলে তিনকূলে কেউ না থাকার মতই অবস্থা। আরেকজন ছমিরন বিবি। সে বলে আমি বেওয়া নই। ব্যাডা মইরা গেছে বইল্যা আমি বেওয়া অইতে যাইমু ক্যান? বাপ মা নাম থুইছিল ছমিরন বিবি, আইডি কাডে আমি হেইডাই দিছি। তর আইডি কাড আছে? তর্জনী ও বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে কচুর লতার আঁশ বাছতে বাছতে প্রশ্ন করে নছিরন বেওয়া।
আছে না? এইডা ছাড়া এখন চলে নি? তুমার নাই?
আছে আছে। কিন্তু থাইক্কাই কোন কামে লাগে? কাজল মিয়া বুলে কইছিল বয়স্কভাতার কাড দিবো। হের লাইগি আইডি লাগবো। দুইবছর অইল দিছি। অখনও কোনু কিচ্ছু অইল না। তুইপাইছস?
ধুরঅ না। মাসে তিরিশ কেজি মোটা মোটা চাউল দেয়। ভাত রানলে গলাত লাগে অত মোটা ভাত। কি করুম পেটের জ্বালায় খাই! কয়না মাইনষে ভিক্ষার চাউল কাঁড়া আর আঁকাড়া? আমার হইছে হেই দশা।
ফাতেমা চুপচাপ শুনছিল। তাদের তিনজনেরই হাত লতা বাছায় ব্যস্ত। লতাগুলো তারই। রেললাইনের পাশে কচুবন থেকে তিনজনে মিলে লতা তুলে এনেছে একটু আগে। এখন কুটাবাছা প্রায় শেষের দিকে। ফাতেমার না, তার বুড়ার যেন ইচামাছ দিয়ে কচুর লতা খাওয়ার শখ হয়েছে। ইচা মাছ থাকলে কচুর লতা হয় না। কচুর লতা হলে ইচা মাছ থাকে না। আজ কুটুমবাড়ি থেকে ইচা মাছ দিয়েছে। সেকথা শুনে তার নতুন পাতানো এই বান্ধবীরাই উদ্যোগ নিয়ে লতা তুলে কুটোবাছায় সহযোগিতা করে ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে এল। এখন ট্রেন এলে তাতে চড়ে বাড়ি পৌঁছলেই হয়। বুড়া চেয়ে আছে পথের দিকে। ফাতেমার ছেলে নেই। মেয়ে একটা ছিল। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে বাচ্চা জন্ম দিত গিয়ে মারা গেছে। এখন বুড়া ছাড়া আর কেউ নেই তার। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক তার অসুখ হলে একটুও যত্ন করেনি। মেয়ের কথা মনে করে সে চোখ মুছে। বলে আমরার মাইয়ো, হিয়াল কুত্তার জীবন। অসুখ অইলে ম্যায়ালুকের বুলে ডাক্তার বদ্যি অখনো লাগেনা। কাইন্দা চউখের পানি হুকাইছে। অখন আর কান্দন আয় না। বুড়াবুড়ি বইয়া বইয়া দিন গুনি।
সংসার কেমনে চলে?
চলে। বুড়ার একটা বয়স্ক ভাতার কাড আছে। ছয়মাসে তিনহাজার টেহা পাই। মাইনষে সায়-সাহ্য করে। মিলাইয়া ঝুলাইয়া খাইয়া না খাইয়া এমবেই চলে। নছিরন ছমিরণও একসাথে বলে, আমরারও এমবেই চলে।
লতা বাছা শেষ হলে ছমিরন কোথা থেকে একটা পলিথিন এনে তাতে লতার টুকরোগুলো গুছিয়ে দেয়। তারপর নসিরন নিজের কৌটা থেকে পান বের করে। তিনজন মিলে পান খায়। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চুন লয়। তা থেকে কিছুটা দাঁতে কেটে বাকিটা রেল পোস্ট অফিসের দেয়ালে মুছে। তারপর একজন আরেকজনের দিকে সকরুণ চোখে তাকায়। একজন আরেকজনের পিঠে মাথায় হাত বুলায়। বলে, ভালো থাইকো বুবু। অবশেষে চট্টগ্রাম অভিমুখী কর্ণফুলী ট্রেন এলে দুজন মিলে ফাতেমাকে ঠেলাঠেলি করে তুলে দেয়। তারপর ট্রেন চলে যাওয়া পর্যন্ত চেয়ে থাকে। যেমন করে গর্ভধারিণী মা কিংবা সহোদর বোনরা চেয়ে থাকে।