:: মোঃ শাহাদত হোসেন ::
“ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।”
– বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলার বর্ষা নিয়ে লিখতে গেলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে তা কল্পনাও করা যায়না। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘বর্ষামঙ্গল কবিতা’ নামক গানটির প্রথম কলি দিয়েই তাই আমিও আমার আজকের লেখা শুরু করেছি। আসলে বাংলা প্রায় সকল কবি ও সাহিত্যিকগণ বর্ষাকে নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। সেসব লেখার উদ্ধৃতি দিতে গেলে নিজের আর কিছুই লেখা হবে না। অতএব, কবি-সাহিত্যিকদের কথা নয়, বরং নিজের কথাই বলি।
বাংলার ঋতুচক্রে বর্ষা মহান সৃষ্টিকর্তার এক অনবদ্য সৃষ্টি। বর্ষার রিমঝিম শব্দ যেমন এদেশের অনেক মানুষকে কবি হতে রসদ জুগিয়েছে, তেমনি বর্ষার ঢেউ আর মাঝির জীবন বাজি রেখে নৌকা চালানো সৃষ্টি করেছে অনেক সাহিত্যিককে। শুধু তাই নয়, বর্ষার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বাড়িঘর হারিয়ে একদিকে সর্বস্বান্ত হয়েছে কৃষক, অপরদিকে হাট-ঘাট-মাঠ ডুবে পলিতে ভরে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে সেই কৃষককেই। তাই বর্ষা শুধু একটি ঋতু নয়, এ যেন আবহমান বাংলার মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ঋতুচক্র অনুযায়ী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস বাংলাদেশে বর্ষাকাল। তবে আবহাওয়াবিদগণ বাংলাদেশকে মূলতঃ তিনটি দৃশ্যমান ঋতুতে ভাগ করে আবহাওয়ার বিবরণ দেন এবং সেই হিসেবে জুন হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখানে বর্ষাকাল স্থায়ী হয়। অর্থাৎ গ্রীষ্ম ও শীতকালের মাঝামাঝি বৃষ্টিবহুল সময়কে বর্ষাকাল বলা হয়। উল্লেখ্য যে, জুন মাসে মৌসুমি বায়ু আগমনের সাথে সাথে বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরু হয়।
বর্ষাকালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হতে থাকে। এ বায়ু ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসে বলে এতে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। অন্যদিকে এসময় বাংলাদেশের সর্বত্র পানি থাকে এবং তা বাষ্পে পরিণত হয়ে জলীয়বাষ্পপূর্ণ মৌসুমি বায়ুর সাথে মিলিত হয়। জলীয়বাষ্পপূর্ণ এ বায়ু প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে পরিচলন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টিপাত ঘটায়। সেজন্য বর্ষাকালে বাংলাদেশে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের মোট বৃষ্টিপাতের পাঁচ ভাগের চার ভাগই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। মাঝেমাঝে মনে হয়, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে।
আর এ বৃষ্টিই বাংলার বর্ষাকে মহিমান্বিত করেছে। বর্ষাকালে এদেশের মানুষ কিছুটা অবসর সময় কাটায়। তাই গ্রামাঞ্চলে বিবাহ অনুষ্ঠান, পালাগান, কুস্তি ও হাডুডু খেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের সময়কাল এই বর্ষা। এমনকি গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থের বাড়িতে প্রায়ই আড্ডা জমে। গ্রামের মুরুব্বীরা কোন এক বাড়ির বাংলা-ঘরে বসে হুকোয় টান দিতে দিতে জীবনের গল্প বলে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আটে।
কখনো টানা কয়েকদিন বৃষ্টি চলতে থাকে। চাল ভাজা, সিদ্ধ মিষ্টি আলু, বাদাম ভাজা খেতে খেতে গ্রামের যুবক-বৃদ্ধ সবাই গান ধরে। সেই গানের সুরে নববধূর বুক আনন্দে ভরে উঠে। জীবন হয়ে উঠে মধুর, সুখের।
সেতো গেল বর্ষার গ্রামের কথা, কিন্তু শহরের অবস্থা কেমন? শহরে হাট-ঘাট-মাঠ না থাকলেও রাস্তায় পানি জমে যায়। আর যেখানে পানি জমে না, সেই রাস্তা হয়ে উঠে কর্দমাক্ত। অফিসে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে যেতে জামা-কাপড় কাদায় মাখামাখি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বড় বড় ঠিকাদারেরা রাস্তার সব কাজ শুরু করেন বর্ষাকালে। ভালো ভালো রাস্তাগুলো খুঁড়ে, পানি-কাদায় একাকার করে যানবাহন চলাচলে জট লাগিয়ে দেন। অফিসের বস বা দোকানের মালিককে দেরিতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করা অধস্তনের পক্ষে খুব সহজ হয়।
তবে আধুনিক শহুরে মানুষও এখন বর্ষাকে উপেক্ষা করে না, বরং উপভোগ করে। তাই সবারই প্রত্যাশা থাকে বিকেলের মধ্যেই, বৃষ্টি শুরুর আগেই বাড়ি ফেরার। আজকাল শহরের মানুষ ঘরের বারান্দায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে সুন্দর কোন মিউজিক চালিয়ে দেয়। বৃষ্টি আর মিউজিক মিলে নতুন এক অপূর্ব সঙ্গীতময়তা রচনা করে, হৃদয়কে দোলা দেয়। অন্যদিকে অফিস বা ব্যবসার ছুটির দিনে ভুনা খিচুরি হয়ে উঠে শহরবাসীর অতি প্রিয় খাবার। মাঝেমধ্যে মাংস দিয়ে চিতল পিঠা কিংবা চ্যাপা শুটকির ভর্তা দিয়ে চাপটি পিঠা খেতে বড়ই ভালো লাগে, নিজেকে বাঙালি মনে হয়।
তাই বলা যায়, গ্রাম ও শহর সবখানেই এখন বর্ষার আবেদন বহুমুখী। মূলতঃ বর্ষা এখন রূপময়, কাব্যময়, বিষাদময়, ভালোবাসাময় ও প্রেমময় এক ঋতুর নাম। শুরুটা যেমন ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে, তাই শেষটাও করতে চাই তাঁর কথা ধার করেই। বাংলার বর্ষা নিয়ে কবিগুরু বলেছেন,
“এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরষায়!
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।”
[লেখক : মোঃ শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ। মোবাইল- ০১৭১২২৭৭৫৫২]