:: এস ডি সুব্রত ::
কদম ফুলের সাদা আর হলুদের অপূর্ব মিশ্রণ স্মরণ করিয়ে দেয় বর্ষার আগমন বার্তা। পানি, বৃষ্টি, কদম, হিজল-করচ যেন বর্ষার অনুপম সঙ্গী। করোনা ভাইরাসের কারণে বর্ষার আনন্দ আয়োজন এবছর সীমিত। তবুও মনের ভেতর বর্ষার যে প্রভাব তা তো কমতি নেই। হাওরে বর্ষা যেন তার সমস্ত রূপ মাধুরী ঢেলে দেয় অকৃপণ হাতে। বর্ষা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হারের অনিন্দ্য সুন্দর মায়াবী রূপ।
উইকিপিডিয়ার মতে, “হাওর হল সাগর সদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর”। সায়র বা সাগর শব্দ থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি। হাওর হলো বিস্তৃত প্রান্তর, অনেকটা গামলা আকৃতির জলাভূমি যা ভূ-আলোড়নের ফলে সৃষ্টি হয়। হাওর অঞ্চলে ছয় মাস শস্য ক্ষেত্র থাকে পানির নিচে আর গ্রামগুলো দ্বীপের মতো পানিতে ভেসে থাকে। এটাই বর্ষাকাল। আর ছয় মাস থাকে শুকনো মৌসুম যখন যতদূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায়।
বর্ষার হাওরের বুকজুড়ে চলে অপরূপ জলের নাচন। হিজল-করচে শাপলা-শালুকে হাওর সাজে অপরূপ সাজে। বর্ষার ভরা জলে হাওরে যেন যৌবনের ডাকে আসে। শুকনায় উদাত্ত জলের দেশে সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায় অপরূপ রূপময় সবুজে। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে থৈ থৈ বিশাল জলরাশি। সে জলে চলে কখনো ভাঙ্গা গড়ার খেলা। কখনো আফালের তোড়ে ভাঙে বসতি। কখনো বন্যায় ভেসে যায় গেরস্থালি। অকাল বন্যায় স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার ফসল ভালো হলে হাওরে আনন্দ জোয়ার আসে। বর্ষার বিকেলে চলে নৌকাবাইচ। গ্রামে গ্রামে চলে গাজীর গান, যাত্রাপালা। হাওর অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই ৭টি জেলা।
ইতিহাস মতে, সমুদ্র বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওর। হাওর অঞ্চলে ৩৭৩টা হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, নেত্রকোণায় ৫২টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি। ৩৭৩টি হাওরবেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩০০০ অধিক জলমহাল যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওর ১০-৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওর অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ।
হাওরের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশ হাওর রয়েছে ৪১৪টি। আবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ২৭ মে ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। যার ৭০ ভাগ কৃষিজীবী।
বাঙালির হাজার বছরের যে ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হাওর অঞ্চলের মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা। বাউল জারি সারি ভাটিয়ালি মরমি আর ধামাইল গানের মূল উৎস স্থল হচ্ছে হাওর অঞ্চল। হাওরের রাজধানী আর লোক সংস্কৃতির অন্যতম আধার সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন মরমি সাধক দেওয়ান হাসন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, দুর্বিন শাহ এবং পণ্ডিত রামকানাই দাশ প্রমুখ।
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বর্ণনায় বর্ষার ভাসান জলে হাওরের মানুষের মাছ ধরে খাওয়া আর মনের আনন্দে গান গাওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নৌকাবাইচ আর যাত্রাপালার দেখা মেলে বর্ষার হাওরে। অন্যদিকে অকাল বন্যা অথবা হাওর রক্ষা বাঁধে অনিয়মের কারণে ফসল তলিয়ে গেলে হাওরের সরল-সহজ মানুষের জীবনে দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখা যায় প্রায়ই।
বাংলাদেশের প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠা পানির এ হাওর অঞ্চলে। প্রায় ২৬ হাজার গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত হাওর অঞ্চলের বিষাদের গল্প ফুটে উঠে এভাবেÑ
“মাটির উপরে জলের বসতি, জলের উপর ঢেউ
তরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি, নগরের জানে না কেউ।”
অপরদিকে হাওরের অনন্য রূপ বৈচিত্র্যের দেখা মেলে কবিতার পংক্তিতে
“পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে জলে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে
আকাশ ছড়ায়েছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে
ছুটছে প্রকৃতিপ্রেমী মহোৎসবের প্রশান্তি লাভে অসীমের পানে।”
হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংসহ দেশি-বিদেশি পর্যটক। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরের অপার সৌন্দর্য্য অবলোকন করে হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খি’র দেশ বলেছেন।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও হাওরে মূলত দুটো ঋতু প্রভাব ফেলে। একটা হচ্ছে বর্ষাকাল। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে বাইরা মাস বা বাইসসা কাল। আরেকটি হচ্ছে শুকনো মৌসুম। শুকনো মৌসুমে হাওরজুড়ে সবুজের সমারোহ ধান আর ধান। সোনালী ধান বৈশাখে উঠে কৃষকের গোলায়। আনন্দে ভরে উঠে হাওরের কৃষাণ-কৃষাণীর মন। অন্যদিকে বর্ষায় চারিদিকে থাকে থৈ থৈ পানি। নৌকা হয়ে উঠে যাতায়াতের একমাত্র বাহন। যৌবনবতী হয়ে উঠে হাওর। ফসল ভালো হলে হাওরে বিয়ে শাদির ধুম লাগে তখন। গ্রামে গ্রামে চলে যাত্রাপালা আর মালজোড়া গান। গ্রামের বধূরা অবসর পেয়ে নৌকা করে নাইওর যায় বাপের বাড়িতে মনের আনন্দে। আনন্দ আহ্লাদের মাঝে দুঃখও আছে। আছে অকাল বন্যা বা পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, আছে ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতা। আছে ওয়াটার লর্ডদের জুলুমে নিষ্পেষিত জেলেদের চাপা কান্না।
হাওরের চাপা কান্না ভেদ করে এর শান্ত জলে অবগাহনে হাজারো পর্যটকের মনে প্রশান্তির ঢেউ জাগে। প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রের অপরূপ নান্দনিক ছোঁয়ায় হাওর যেন এখন হয়ে উঠে স্বপ্নের দেশ। হাওর এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং জীববৈচিত্রের্য এক অপার লীলাভূমি। হাওরে পর্যটনবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে একদিকে হাওর বয়ে আনবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা , অন্যদিকে হাওর অঞ্চল তথা গোটা দেশের অর্থনীতিতে বয়ে আনবে নতুন দিগন্ত। এতে হাওরের খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষের জীবনযাত্রায় যেমন পরিবর্তন আসবে, অপরদিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অপার সম্ভাবনার সুনীল দিগন্তে।
[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]