:: মোহাম্মদ আব্দুল হক ::
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন অথবা এ অঞ্চলের মহিলাদের জাগরণের শুরু ভারতীয় জাতির উপর বৃটিশীয় জবরদস্তিমূলক শাসন ও শোষণ চলার সময় থেকেই। এখানে নারী জাগরণ প্রসঙ্গ আসলে বাঙালি মুসলিম নারীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া (বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন)-এর নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। আরও অনেকেই রয়েছেন যাঁরা বাঙালি নারীদেরকে অবমাননাকর অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। সেই সব মহীয়সী নারীদেরকে সব সময় আলোচনায় নিয়ে আসলে আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত নারীদের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হবে। আমাদের মেয়েদেরকে বলি, আপনাদের হাত-পা-নখ-দাঁত এবং সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারদর্শী হোন। সবসময় ভাইয়ার অপেক্ষা না করে নিজেকে রক্ষা করতে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। শাস্ত্রে বলে, ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ মানে ‘আপনাকে জানো’। আমাদের মেয়েরা নিজেদেরকে জানতে সচেষ্ট হোন। একই সাথে এখনও যেসব যুবক কিংবা পুরুষ মেয়েদেরকে সম্মান করতে লজ্জা পায় না, তাদেরও জানা হবে আমাদের নারীরা (দাদি, নানি, মা, বোন, ফুফু, খালা, চাচি) কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের মেয়েদের জন্যে চলার পথ তৈরি করেছেন। আর এভাবে জানতে জানতেই আমাদের যুবকরা (যাদের মধ্যে অল্প পরিমাণ মনুষ্যত্ব বাস করে) নারীদেরকে নির্যাতন করা থেকে বিরত থেকে শ্রদ্ধা করতে এগিয়ে আসবে।
আজকের এই লেখা একজন শিক্ষিত প্রগতিশীল বাঙালি নারীর জীবনের টুকরো অংশ উপস্থাপন করার ক্ষুদ্র প্রয়াস। তিনি আমাদের সিলেটের (সিলেটি বাঙালি) লীলাবতী নাগ, সংক্ষেপে লীলা নাগ।
শিক্ষা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। তাইতো আমাদের নারীরা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। সাথে সাথে আমাদের সৃজনশীল পুরুষরা সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। লীলাবতী নাগ এর জন্ম ভারতের আসামে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর। তাঁর পূর্বপুরুষ অর্থাৎ পিতৃ পুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার পাঁচগাঁও গ্রামে। লীলা নাগের উচ্চশিক্ষিত পিতা গিরীশ চন্দ্র নাগ তৎকালীন বাংলা-আসাম সিভিল সার্ভিসের কর্মচারী ছিলেন। তাঁর মা কুঞ্জলতা দেবী সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ গ্রামের প্রকাশ চন্দ্র দেব চৌধুরীর কন্যা। তিনি ১৯১১ থেকে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকার (তৎকালীন) ইডেন হাই স্কুলে লেখা পড়া শেষে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। লীলা নাগ বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনে আন্দোলিত হন। তিনি লেখাপড়া চালিয়েও তৎকালীন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। জানা যায়, তখন কলকাতার বেথুন কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বড়লাটের পত্নীকে ছাত্রীরা নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের নিয়ম ছিলো। কিন্তু লীলা নাগ কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে এর প্রতিবাদ করেন এবং তারপরেই এই অবমাননাকর প্রথা বাতিল করা হয়। সাহস আর মেধার সাথে লীলা নাগ কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ পড়ার জন্যে ভর্তি হন। আইনগত বাধা না থাকলেও প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার (ছাত্র এবং ছাত্রী এক সাথে পড়ার) আয়োজন ছিল না। কিন্তু লীলা নাগের দৃঢ় মনোবলের কারণে প্রথম উপাচার্য স্যার পি জে হার্টগ মুগ্ধ হয়ে ছাত্রী ভর্তির উদ্যোগ নেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী কে? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই বলে দিতে পারেন ‘লীলাবতী নাগ’ নামটি।
আমাদের জানা দরকার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষাবর্ষের দু’জন ছাত্রী ছিলেন, একজন লীলা নাগ এবং অপর জন সুষমা সেনগুপ্ত। শিক্ষাজীবন শেষ করেই লীলা নাগ নারীসমাজের উন্নয়নের চিন্তা করতে থাকেন এবং এগিয়ে চলেন।
লীলা নাগের ছিলো সংগ্রামী জীবন। তাঁরা চার ভাইবোন এবং সবাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিক। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বরে কোন অভিযোগ ছাড়াই আটক প্রথম সংগ্রামী মহিলা হলেন এই লীলা নাগ। সেই সময় একটানা ছয় বছর কারাবরণ করে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর মুক্তিসংবাদ শুনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে পাঠানো এক পত্রে লিখেছিলেন- ‘মানুষের হিংসার বর্বরতার অভিজ্ঞতা তুমি পেয়েছো আশা করি, একটা মূল্য আছে, এতে তোমার কল্যাণ সাধনাকে আরও বল দেবে। পশু শক্তির ঊর্ধ্বে জয়ী হোক তোমার আত্মার শক্তি।’
লীলা রায় এবং বিপ্লবী অনিল রায় (অনিল রায়কে বিয়ে করার পর লীলা নাগ পরিচিত হয়ে উঠেন লীলা রায় নামে) সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে বিভিন্ন
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে ১৯৪০ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সম্মেলনে মূল প্রস্তাব উত্থাপন করে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন লীলা রায়।
প্রকৃত অর্থে অনেকের মতো লীলা নাগ বৃটিশ শাসনের অবসান চাইতেন, কিন্তু তিনি ভারত বিভক্তি চাইতেন না। তিনি কতোটা ভারতীয় ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯১৭ সালের ২ অক্টোবর তাঁর ১৭তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর পিতাকে লেখা চিঠিতে। লেখাটি ছিলো এরকম- “আমার ক্ষুদ্র শক্তি যদি একটি লোকের উপকার করতে পারতো, তবে নিজেকে ধন্য মনে করতুম। সত্যি বলছি এ আমার বক্তৃতা নয়, এটা আমার প্রাণের কথা। এই আমার Ideal – আশীর্বাদ করো যদি এ জন্মে কিছু না করতে পারি,আবার যেন এই আমার প্রিয় ভারতবর্ষেই জন্মগ্রহণ করি, একে সেবা করে এ জন্মের আশা মিটাতে।”
প্রিয় পাঠক, লীলা নাগ আগাগোড়া একজন ভারতীয় ছিলেন। তিনি বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেছেন। বৃটিশীয় শাসন থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তার ভিত্তিতে বিভক্ত স্বাধীন ভারত তিনি চাননি। তাইতো ইতিহাসের আলোকে দেখতে পাই, তিনি ছুটে গেছেন গান্ধিজি ও পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে ভারত বিভক্তি ঠেকাতে। কিন্তু তিনি নেতাদেরকে ঠেকাতে পারলেন না। অবশেষে দেশ ভাগ হলো, এক ভারত রইলো না। তাই তিনি স্বামী অনিল রায়কে সাথে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে নিজ দেশ পূর্ববাংলাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। এখানে এসেই তিনি সমাজসেবা মূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমাদের আরেক মহীয়সী নারী কবি সুফিয়া কামাল লীলা নাগের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এখানে উল্লেখ করছি, নানা প্রতিকূলতার চাপে লীলাবতী নাগকে পরবর্তীতে নিজ দেশ ছাড়তে হয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলের গৌরবের ব্যাপার যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ। এই আজীবন সংগ্রামী নারী মানবতাবাদী বিপ্লবী লীলাবতী নাগ ১৯৭০ খ্রিস্টিয় সালের ১১ জুন মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও যেসব অনাচারের এবং কুসংস্কারের বীজ লুকিয়ে রয়েছে তার সমূল বিনাশ ঘটাতে লীলা নাগের মতো মহীয়সী নারীদেরকে সময়ের প্রয়োজনে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য মনে করি।
[লেখক : কলামিস্ট]