:: এস আই শিমুল ::
১৯৭১-এর রণাঙ্গনের বীর সৈনিক এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম লুৎফুর রহমান জজ মিয়া। জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের ক্রান্তিলগ্নে যিনি বীরদর্পে লড়াই করেছেন স্বদেশ প্রীতি ও মাতৃভূমির টানে। গত ৯ই মে, রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে গেছেন উত্তর সুনামগঞ্জের প্রাণপুরুষ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান লুৎফুর রহমান জজ মিয়া।
১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন জজ মিয়া। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ভৈরব কলেজ ছাত্রলীগের মনোনয়ন পেয়ে ‘কমন রুম সেক্রেটারি’ পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান যিনি জজ মিয়াকে গায়ে হাত বুলিয়ে তৎকালীন ছাত্র সংসদে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ১৯৭০-এ নরসিংদী, রায়পুরা থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের থানা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জজ মিয়া। ৭১-এর ৭ ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই ঐতিহাসিক ময়দানে লুৎফুর রহমান জজ মিয়া উপস্থিত ছিলেন তার বন্ধু বান্ধব ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে। সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে শরীরের প্রত্যেকটা লোম জেগে ওঠেছিল, রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল এবং মনে হয়েছিল ইতিমধ্যেই আমরা বুঝি স্বাধীন হয়ে গেছি।’
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে জজ মিয়া ও তার স্বজনরা রায়পুরা থেকে পায়ে হেঁটে সুনামগঞ্জ এলেন। সুনামগঞ্জের ডলুরা বর্ডার এলাকায় তখন অনেক ছাত্র ও যুবক এসে জড়ো হচ্ছিল এবং সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়া যায়। তবে একদিন বালাটের বিএসএফ সীমান্তের ওপারে জজ মিয়াকে আটক করে ফেলে। তখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব হোসেন বখত জজ মিয়াকে বালাটের বিএসএফ-এর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। হোসেন বখতের নেতৃত্বেই তখন মুক্তিযুদ্ধের কমিটি গঠিত হয়েছিল। তখন পুরো তিনটি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি ব্যাচের কমান্ডার ছিলেন জজ মিয়া। ২৮ দিন ট্রেনিং শেষে জজ মিয়া দেশে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধের সময় একদিন ডোবার ধারে এক মুক্তিযোদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখেন। যার মাথায় গুলি লেগেছিল, মাথার অর্ধেক নেই, তিনি জজ মিয়ার কাছে পানি চেয়েছিলেন, কাপড় ভিজিয়ে মৃত্যু পথযাত্রী সহযোদ্ধাকে সেদিন পানি খাওয়ালেন জজ মিয়া, পরক্ষণেই চোখের সামনে সহযোদ্ধার নির্মম মৃত্যু দেখেছিলেন। সহযাত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধে ডলুরা নদীর পাড়ে এক রাজাকারের গলায় পারা দিয়ে হত্যা করেছিলেন জজ মিয়া। মারা যাওয়ার আগে ঐ রাজাকার কুকুরের মতো জজ মিয়ার পায়ে মরণ কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। ওই কামড়ের চিহ্ন রয়ে যায় তার পায়ে।
জজ মিয়া তার সহযোদ্ধাদের বলতেন, রাজাকারদের গুলি করে হত্যা করে অযথা গুলি নষ্ট করার দরকার নেই। রাজাকারদের গলা কেটে হত্যা করতে বলতেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও জজ মিয়া একসাথে ট্রেনিং করেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির তখনকার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি শেষ বার যখন সুনামগঞ্জ এসেছিলেন তখন নিজ থেকেই তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ স¤পাদককে বলেছিলেন জজ মিয়ার সাথে দেখা করার জন্য এবং জজ মিয়ার সাথে সেদিন প্রাণ খুলে কথা বলেছিলেন।
লুৎফুর রহমান জজ মিয়া এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যিনি নিজে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি। তার সহযোগী যোদ্ধারাই তা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। যিনি তার কর্মকালীন কোন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পর্যন্ত নেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে সংসদ ভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছিলেন তিনি। তথাকথিত ‘বড় মাপের’ হওয়ার ইচ্ছে তার কখনো ছিল না। তবে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন সব সময়। তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, তবে স্বদেশের তরে তার ত্যাগ ও দেশপ্রেম আজীবন এদেশের মানুষ স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে।