:: এস ডি সুব্রত ::
বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল যে নক্ষত্র তার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য, সঙ্গীত আর মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন পারিবারিক আবহের মাঝে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজের কারণে দেশে এবং দেশের বাইরে থাকতেন বেশিরভাগ সময়। রবির ছেলেবেলার দিনগুলি কেটেছে বাড়ির কাজের লোকদের শাসনে। কিংবদন্তী এই মহান সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছিল কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ১৯৬১ সালের ৭ মে বাংলা ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ। মৃত্যুবরণ করেন ৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদা সুন্দরী দেবী।
তখন কলকাতা পুরোপুরি শহরে রূপ নেয়নি। রাস্তাঘাট অধিকাংশ কাঁচা। মিউনিসিপ্যালিটির কলের ব্যবস্থাও তখন হয়নি। অজস্র পুকুর ছিল এখানে-সেখানে। তখন স্নান ও পান চলত এই জলে। হ্যাঁ, এটা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার কথা।
ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নেয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কবিগুরু তাঁর ছেলেবেলা বইতে নিজেই বলেছেন, “আমি জন্ম নিয়ছিলুম সেকেলের কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হার বের করা ঘোড়ার পিঠে, না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত হাঁস-ফাসানি ছিল না। রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন তামাক টেনে নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে। কেউবা পালকি চড়ে কেউবা ভাগের গাড়িতে।”
রবির ছেলেবেলায় মেয়েদের চালচলনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “কোন মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতা দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি, তার মানে লাজ শরমের মাথা খাওয়া, কোন মেয়ে যদি হঠাৎ পড়ত পর পুরুষের সামনে ফস করে ঘুমটা নামত নাকের ডগা পেরিয়ে, জিভ কেটে চট করে দাঁড়াত পিঠ ফিরিয়ে।”
সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় যার বিচরণ সেই মেধাবী রবি’র পড়াশোনায় তেমন ঝোঁক ছিল না। পড়তে বসলেই ঘুম পেতো।এ স¤পর্কে কবি নিজে বলেছেন, “….. মাস্টার মশায় মিটমিট আলোতে পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক, প্রথমে উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম, তারপর চলত চোখ রগরানি।”
ছোটবেলায় রবি ছুটির দিনে সবার অলক্ষে গিয়ে বসতেন পালকিতে আর হারিয়ে যেতেন কল্পনার রাজ্যে। কেটে যেতো দিন। পালকির কথা বলতে গিয়ে রবি ঠাকুর বলেন, “…. আমাদের চালচলন ছিল গরিবের মতো। গাড়ি ঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই চলে। বাইরের কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটি পালকি গাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহায়েত সাদাসিধে।”
রবির ছেলেবেলার সন্ধ্যা কাটত বাড়ির চাকরদের মহলে। নবাবী জবানীতে চাকরনোকরদের মহলকে বলা হতো তোষাখানা। তোষাখানার দক্ষিণে বড় একটা ঘরে কাঁচের সেজে রেড়ির তেলে আলো জ্বলত মিটমিট করে। ছেলেবেলায় রবির স্বাস্থ্য ছিল বেশ ভালো। খাবার খেতেন কম, তবে কখনো কাহিল হননি।ত ার সমবয়সী যারা বেশি খেতো তাদের চেয়ে তার গায়ের জোর বেশি ছিল। নিজের স্বাস্থ্য স¤পর্কে রবি বলেছেন, “… শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, স্কুল পালাবার ঝোঁকে যখন হয়রান করে দিতো তখন শরীরে কোনরকম জুলুম করেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না।”
রবি জুতো জলে ভিজিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে সর্দি আনতে পারতেন না। তখন ভূতের ভয় যেমন ছিল মানুষের মনজুড়ে ছিল ডাকাতির গল্প ঘরে ঘরে। তখন ডাকাতির খেলা হতো। রবীন্দ্রনাথ একদিন সে খেলা দেখছিলেন নিজ বাড়ির উঠানে। মস্ত মস্ত কালো জোয়ান সব, লম্বা লম্বা চুল। রবি ছেলেবেলায় গানের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তার গানে হাতেখড়ি দিয়েছেন বিষ্ণু ওস্তাদ। সে সময় অবশ্য হারমোনিয়াম ছিল না এদেশে। কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যাস করেছিলেন রবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম কবিতা লিখেছেন যখন তাঁর বয়স মাত্র সাত। সেই থেকে শুরু। তাঁর লেখায় ধন্য হয়েছিল বাংলা সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ যখন কিছুটা বড় হয়েছেন তখন বিছানা থেকে উঠেই ছুটতেন গোলাবাড়ির দিকে। সেখানে শহরে এক ডাকসাইটে পালোয়ান ছিল। কালা পালোয়ান। তার কাছে কুস্তি লড়তে যেতেন তিনি। কবির ভাষায়- “সে ঘরে এক হাত আন্দাজ খুঁড়ে মাটি আলগা করে তার এক মোন সরষের তেল ঢেলে জমি তৈরি হয়েছিল। সেখানে পালোয়ানের সঙ্গে আমার প্যাচকষা ছিল আমার ছেলেখেলা মাত্র। খুব খানিকটা মাটি মাখামাখি করে শেষকালে গায়ে একটা জামা জড়িয়ে চলে আসতুম। সকাল ৭টায় নীলকমল মাস্টার আসতো পড়াতে। তিনি বাংলায় শেখাতেন সব পড়া। পাটি গণিত, বীজগণিত, রেখাগণিত এমনকি সাহিত্যের সীতার বনবাসে থেকে মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে আসতেন বিজ্ঞানের স্যার সীতানাথ দত্ত। বেলা ৯টা বাজলে বেটে কালো গোবিন্দ কাঁদে হলদে রঙের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে রবিকে নিয়ে যেতো স্নান করাতে। সাড়ে ৯টার খাবার, ১০টায় যেতেন স্কুলে পালকিতে। সাড়ে ৪টায় বাড়ি পৌঁছে জিমন্যাস্টিকসের মাস্টারের কাছে যেতেন। তারপর ছবি আঁকার মাস্টারের কাছে। সন্ধ্যা হলেই আসতেন অঘোর মাস্টার ইংরেজি পড়াতে। রাত ৯টার পড়া শেষ করে ভেতরবাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শুতে যেতেন। তখন শংকরী দাসী কিংবা প্যারী দাসী রূপকথার গল্প বলতেন। মনের মাঝে কল্পনার রং ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নক্ষত্র রবি ঠাকুর।
[লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক]