:: সম্পা তালুকদার ::
মানুষ হয়ে জন্মেছি যারা তারাই রচে যায় জীবনকাব্য। চারিদিকে কতশত জীবেদের আনাগোনা। কত বিচিত্র বৈচিত্র্যতা নিয়ে প্রকৃতি খেলা করে, হারায় কেহ তার প্রেমে, কেউ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকে, লড়ে যায় আমরণ, আবার কেউ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে নিজ স্বার্থে। এই যে জগতে চক্রাকার খেলা চলছে নিরন্তর; সেথায় কেউ জয়ী, কেউ পরাজিত, কেউ স্ব-মহিমায় মহিমান্বিত। বিধাতার দয়ায় আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। শ্রেষ্ঠত্বের আনন্দের চেয়ে অহমিকায় মেতে আমরা গল্প সাজাই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে, ভিন্ন ধারায়। এ জাতি যেন এক আজব অদ্ভুত রহস্যময়।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “বহুরূপে সমুখে ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
আবার “স্বর্গ নরক” কবিতায় কবি শেখ ফজলুল করিম বলেছেন, “কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর / মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।” চণ্ডীদাস বলেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” এমনই কতো মহামানব, মহামনীষীগণ এবং কবি-সাহিত্যিকরা লিখে গেছেন কতো বাণী, কাব্য ও গল্পগাঁথা।
বাস্তব জীবনে আমরা কেউই এর বাইরে নয় বা এতে কি আমরা দ্বিমত পোষণ করি? তাই যদি হয়, তবে কেন মানুষে মানুষে এতো হানাহানি, মারামারি, এতো লোভ-লালসা, ক্ষোভ? আসলে আমরা সবাই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াই। প্রতিটি মানুষের জীবনে চাহিদা আছে, চাহিদার কতটুকু পূরণ করা উচিত বা অনুচিত তা যদি আমরা জেনে থাকি তাহলে তো সব মিটে যায়। কিন্তু আমরা আসলে জেনে বুঝে নিজ স্বার্থে এতোই পাগল যে, মানুষ হয়েও আমরা প্রতিনিয়ত অমানবিক কার্যকলাপে মত্ত।
মানুষ মাত্রই মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং শিষ্টাচারগুলো জানা ও পালন করা উচিত। কেউ হয়তো বলবেন ক’জনে এসব জানে বা অশিক্ষিতরা কি শিষ্টাচার বা নৈতিকতার শিক্ষা পায়? আমি বলবো নৈতিকতা এবং মানবিকতা প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিদ্যমান, শুধু তা জাগাতে হবে। এছাড়া সমাজের সকল ধরনের অমানবিক, নৃশংস ও দুর্নীতিমূলক কার্যক্রমে শিক্ষিত ব্যক্তিরাই বেশি জড়িত। অশিক্ষিত মানুষেরা যা করে তারা তাদের অজ্ঞানতা থেকে করে, আর আমরা শিক্ষিতরা জেনে বুঝে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে থাকি। সমাজে কতশত সমাজপতিরা ধর্ষণ, খুন, নারীপাচার, লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতির সাথে জড়িত তা আমাদের অজানা নয়। এর থেকে মুক্ত নয় আমাদের ধর্মযাজকেরাও। আমি ঢালাওভাবে সবাইকে বলছি না, কেননা কথায় বলে না “সরষে ক্ষেতেও ভূত থাকে।”
বর্তমান সমাজে এতো এতো উন্নয়নের জোয়ার, এমনকি নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীদের সর্বক্ষেত্রে বিচরণের অভূতপূর্ব উন্নতির মাঝেও পদে পদে নারীরা লোলুপ কামনা-বাসনার শিকার হয়ে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত হচ্ছে, এটা নিত্যদিনের সমাচার। কিছু কিছু নারীরাও পৈশাচিকতায় কম যায় না। এ সমাজ এতটাই কলঙ্কিত যে, পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষিত হচ্ছে তাও শোনা যায়। এজন্যই কি আমরা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার? সমাজ কতটা নষ্ট হলে ঘরে স্ত্রী রেখে কন্যাসম মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টিপাত করে, এমনকি পাগল বা গৃহকর্মীর দিকে চোখ ফেলে। কতটুকু নিচে নামলে অসহায়, বিধবা এবং পথচারীর দিকেও কুনজর এড়াতে পারেনা। রাস্তাঘাটে, অফিসে-আদালতে, স্কুল-কলেজে, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কোথায় নেই এসব বলতে পারেন? আমরা সাধু, ধরা পড়লে বুঝা যায় কতটা কপটতায় ঢাকা। অর্থের দম্ভে মানুষ এতটাই বেহুঁশ যে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সময়ে কারা অপরাধী জানেন….? আমি বলবো যারা সত্য কথা বলে। এদের নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পণ্ডিত বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়ে গেছে স্বাভাবিক। এখন প্রায়ই বলতে শোনা যায়, “এতো সত্য বলার কি প্রয়োজন, উনি কি সত্য বলে জাতিকে উদ্ধার করে ফেলবেন, দেশে মনে হয় সত্য বলার আর কেউ নেই।” তাহলে সত্য বলবে টা কে? প্রশ্নটা রইলো সবার কাছে?
যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকগণ এবং মহামনীষীগণ দেশ ও সমাজের অসঙ্গতি তোলে ধরেছেন লেখালেখির মাধ্যমে এবং জীবনাচরণ করে। এর জন্য শাস্তি-নির্যাতনও পোহাতে হয়েছে এসব নজিরও আছে। এ সমাজে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হয় নারী, বৃদ্ধ, পথশিশু, শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম আছে, কোথাও কম কোথাও বেশি। তবে যাঁদের কথার মূল্য বেশি তাঁরা দয়া করে একটু সমাজের দিকে তাকান, একটু ভালো দিকে পরিচালিত করুন আমাদের দেশ ও জাতিকে।
প্রতিটা মানুষের যেমন মৌলিক অধিকার আছে, তা শুধু কাগজে-কলমে না রেখে বাস্তবচিত্রে চিত্রিত হোক। আর এজন্য এক নয় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আবার একা আমি বলবো বা করবো কেন এমন ভাবলেও চলবে না, কেননা এক থেকেই বহু’র সৃষ্টি। একজনের কাজের সুফল পায় অন্যজন। আর এভাবেই এগিয়ে যায় মানুষ। সংকীর্ণতা, নীচতা, ব্যক্তি চিন্তার বাইরে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কোথায় নেই দৈন্যতা? পরিবার থেকে রাষ্ট্রে সর্বত্র বিরাজমান। যে বাবা মা সন্তানকে শত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষ করে, সেই বাবা মাকে বৃদ্ধাবস্থায় ভরণ-পোষণ না করে কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করে। এমনকি তাদের শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। আমাদের সমাজে সন্তান পিতা-মাতাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে, সদুপদেশ দিলে বাজে মন্তব্য করে, এমনকি ঐশী নামের এক মেয়ে তার পুলিশ অফিসার বাবাকে পর্যন্ত খুন করেছিল, এটা সবার মনে থাকার কথা। শুধু এমন একটা কেন শত শত কাহিনী আছে অজানায়, অগোচরে। হয়ত কতো মা, কতো বাবা, কতো বোন, কতো ভাই কাঁদছে নীরবে অসহায়ের মতো। এই অসহায়ত্বের কাহিনী নয় কি তোমার আমার? নয় কি কলঙ্ক সবার? নাকি যার ভাগ্য মন্দ তারাই এর শিকার?
মানুষ হিসাবে আমরা যে যার মত – পথে চলার অধিকার ও আবেদন জানাই। কেউই শতভাগ শুদ্ধ নই, তবুও সুন্দরের দিকে ধাবিত হতে হবে, সত্যকে মানতে হবে, সবার চিন্তা-চেতনায় মতপার্থক্য থাকলেও নীতি ও আদর্শকে সম্মান জানাতে হবে। পরশ্রীকাতরতা পরিহার করে, ভালোকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে বলবো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র ভুলে সবাই মানুষ হিসাবে বাঁচার দৃঢ় প্রয়াস হোক আমাদের অঙ্গীকার।
[লেখক : সম্পা তালুকদার, সহকারী শিক্ষক, মল্লিকপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়]