:: সুখেন্দু সেন ::
উত্তরের মেঘালয়ের গিরিখাত বেয়ে সমতলের মায়াবী আকর্ষণে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারা ছলছল আবেগে রেণুকা নদী হয়ে বয়ে চলে প্রাচীন লাউড় রাজ্যের বুক চিরে- সেই কোন আদ্যিকাল থেকে। নদীর তীরে সমৃদ্ধ জনপদ। বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতির আদিকেন্দ্র বিখ্যাত হয়ে আছে বৈষ্ণবাচার্য শ্রীঅদ্বৈতের নামে। মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদক মহাকবি সঞ্জয়, পণ্ডিত কুবেরাচার্য, নরসিংহ নড়িয়াল, দিব্যসিংহ পণ্ডিতবর্গও এ রাজ্যের জন্মধন্য পুরুষ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিবিড় চিহ্নসূত্র অংকিত হয়ে আছে রেণুকার তীরে তীরে। প্রকৃতির রহস্যে অনেক দিনে অনেক জল গড়িয়ে গেছে বহতা নদীতে। আজ আর সে রাজাও নেই, লাউড় রাজ্যও নেই। স্বর্ণরেণুর মতো ছড়িয়ে থাকা দু’ধারে বিশাল বালুকাবেলায় প্রবাহিত স্রোতস্বিনী কখন যে নাম বদলে যাদুকাটা হয়ে গেছে- সে অন্য ইতিহাস। তবে সেই স্নিগ্ধ জলধারা আজো বহমান, সকল গৌরবগাঁথা অক্ষুণ্ন রেখে। কখনো নবসংযোজনে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে পুষ্ট করে দিয়ে। অপরূপা আদিপ্রকৃতি আর গৌরবের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রাচীন অঞ্চলটি বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় নির্দিষ্ট হয়ে আছে।
যাদুকাটার তীর ঘেঁষে সবুজ শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত নিভৃত এক পল্লী বিন্নাকুলি’র সৌম্যদর্শন এক শিশু। নদীর স্বচ্ছ জলের মতোই উজ্জ্বল চোখ, গৌরকান্তি, তীক্ষè নাসা। পিতা খ্যাতিমান সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী’র রক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে সেই শিশুটি বিশাল পৃথিবীর পথযাত্রায় শৈশব ও তারুণ্যের দিন কাটায় সুরমা তীরের ছোট্ট মহকুমা শহর সুনামগঞ্জে।
আমি তখন জুবিলীর নিচের ক্লাসের ছাত্র। উঁচু ক্লাসের একজন তরুণ শ্রেণিকক্ষ ঘুরে ঘুরে শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা’র সদস্য সংগ্রহ করছেন। সদাচারী সুদর্শন তরুণের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর মমতার ঠিকানায় মেলার সৌভাগ্যবান প্রথম সদস্য আমি। সালটি ১৯৬১। স্কুলের খাতায় ছন্দ মিলিয়ে দু-চার লাইন কবিতা লিখি, তাও সংগঠকের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়াতে পারে না। পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেন। প্রেরণায় লেখা হয় কিছু – কিছু কিছু হয় না। এ থেকে দু-তিনটি ছাপিয়ে দিলেন স্থানীয় ‘সুরমা’ পত্রিকায়। চর্চায় কিছুটা হাত খুলে, ছাপা লেখায় আনন্দে মনও দোলে। কিছুদিনের মধ্যেই একটি কবিতা অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরের পাতায় ঠাঁই পেয়ে গেল। কচি মনে ভুবনজয়ী আনন্দ। মেলার সদস্য হিসেবে আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনাচারের ব্রত। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষণ, মহড়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। কচি-কাঁচাদের মনোজগতে প্রজাপতির বর্ণিল ডানার মতো সুন্দর আগামীর স্বপ্ন বোনার কাজটি করে দিতেন নিপুণ রঙ কারিগর সেই প্রাণবন্ত সংগঠক। জুবিলীর পাঠ শেষ করে চলে গেলেন মহাবিদ্যালয়ে। তবুও মেলার সাথে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ, সঙ্গে উৎসাহ-উপদেশ। কলেজে দু’বছরের পড়া শেষে সংগঠনের প্রাণপুরুষ উচ্চশিক্ষা নিতে পাড়ি দিলেন আরব সাগরের তীরে, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুরমা কাকলি কচিকাঁচার মেলার কলকাকলিও ক্রমে স্থিমিত হতে থাকে, আমারও আর কবি হয়ে উঠা হয়নি।
সাংবাদিকতার সূচনা করেছিলেন সুনামগঞ্জের সুরমা পত্রিকায়। ছাত্রাবস্থাতেই দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা। করাচি থেকে জীবন সমারোহের পথে শুরু অক্লান্ত পরিব্রাজনের পালা। যোগ দেন ইংরেজি ডন পত্রিকায়। সেই সাথে ইত্তেফাকের করাচি প্রতিনিধি। তখনকার ইত্তেফাক বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। স্বায়ত্বশাসন, ছয় দফার প্রচারণাই শুধু নয়, ইত্তেফাকের ভাষা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভাষা। রাজনীতিকদের অনেকেই কথা বলেন ইত্তেফাকের ভাষায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সামরিক কেন্দ্রের নাটের গুরুদের ছলা-কলা, কূটকৌশল, চক্রান্ত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে করাচিতে। বঞ্চনার বেদনা পূর্ব বাংলার অংশে। সে বেদনার উৎসমূলের নানা কাহিনী অপকটে উন্মোচিত করে দেন সংবাদপত্রের পাতায়। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সংবাদপত্র আর বিশ^ সংবাদ মাধ্যমের বিশাল সাম্রাজ্যের স্বর্ণদ্বার খুলে যেতে থাকে সম্মুখে। একে একে ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি, কূটনৈতিক সংবাদদাতা, চিফ রিপোর্টার এবং নির্বাহী সম্পাদক। মর্নিং নিউজ, ডন, ইভনিং স্টার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার, দুবাইয়ের খালিজ টাইমস্, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এশিয়ান এজ, ডেকান হেরাল্ড পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি। মর্যাদাশীল আন্তর্জাতিক সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইকের করসপনডেন্ট। চট্টগ্রামের ডেইলি পিপলস্ ভিউ-এর প্রধান সম্পাদক, ঢাকার ডেইলি সান-এর প্রথম সম্পাদক। পেশাগত দায়িত্বে যাদুকাটা-সুরমা তীরের বালু-কাদা মাখা সন্তান বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর পেরিয়ে আটলান্টিক প্যাসিফিকের তীরে তীরে নোনা হাওয়ায় ছুটে বেড়িয়েছেন সত্যসন্ধানী পরিব্রাজকের মতো। বিশ্বের তাবৎ ঝানু ঝানু রাজনীতিক, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানদের সান্নিধ্যে এসেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নিপুণ কুশীলতায় অবলীলায় বের করে এনেছেন জটিল বিশ্ব রাজনীতির সদর-অন্দরের খবর। নির্মোহ অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন উপমহাদেশের বিচিত্র রাজনীতির হাল-চাল, গতিপথ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানীর স্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছেন। ঘনিষ্ঠতা ছিল সমসাময়িক প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু যখন তরুণ, মেধাবী নতুন মুখদের রাজনীতিতে সক্রিয় করার প্রয়াসী ছিলেন, তখন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ভাবশিষ্য আর কাজী নজরুলের যৌবনের অবিকল প্রতিকৃতি বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের তুখোড় এই সাংবাদিকও পেয়েছিলেন সে আহ্বান। রক্তে যাঁর পাগলপারা সাংবাদিকতার নেশা, কি করে ছাড়েন সাংবাদিকতা এবং আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া সংবাদপত্র জগৎ। স্বপেশায় সত্যনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছিলেন বলেই রাজনীতিক হয়ে উঠা হয়নি। বরং ক্রম উত্তরণে আরোহণ সাংবাদিকতার শীর্ষপর্যায়ে। সাংবাদিক জীবন থেকে অবসর নিলেও রক্তের টানে কলাম লিখেছেন বিভিন্ন কাগজে। ঐতিহাসিক-দালিলিক গ্রন্থ ‘নিউজ উইক-এ বাংলাদেশ – মুক্তিযুদ্ধ বিজয় এবং তারপর’ তাঁর অনবদ্য কৃতি। ‘অতীত অতীত নয়’, ‘সব ভাল যার শেষ ভাল’ এবং ‘যারে দেখতে না-রি তার চলন বাঁকা’, বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রতিবেদনের সংকলিত আরো দু’টি গ্রন্থিক কৃত্য।
দু’পাতাজুড়ে লেখা হয়ে গেল অনেককিছু। কিন্তু লেখা হলোনা কোনো কিছুই। যাঁকে নিয়ে লেখা তিনি যদি হন আমাদের শৈশবের বিস্ময় ব্যক্তিত্ব হাসান শাহরিয়ার, তাহলে শেষ করি কি দিয়ে। শুরুতেই যে স্মৃতিতে-মননে ছুঁয়ে গেছে প্রগাঢ় এক স্নেহের ছায়া, আটকা পড়ে আছি সেই বন্ধনে। ঘোরপাক গৌরচন্দ্রিকাতেই।
এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রথিতযশা সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার-এর কথা লিখতে গেলে লিখা যেত তাঁর খ্যাতি, যশ, অন্তর্দৃষ্টি, মেধা, প্রতিভা, সততা, সত্যনিষ্ঠা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণের কত-শত হীরন্ময় অর্জনের গল্পগাঁথা। এমন বর্ণাঢ্য সমৃদ্ধ জীবন সমারোহ হাতড়িয়ে বিচিত্র মণি-মানিক্যের সন্ধান, আমার কর্ম নয়। সে জন্য অনেক দক্ষ জহুরী, জ্ঞান-গুণী মহাজনেরা রয়েছেন। আমি বরং দেখি একজন সহজ-সরল আবেগী ভালবাসার কাদামাটি মন হাসান শাহরিয়ার ভাইকে। পেশাগত সাফল্য আর খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেও যিনি আপন মানুষকে, নিচের মানুষকে খাটো দেখেননি। অহংকার যাঁকে বশ করেনি। এমন বিশালত্বেও আত্মম্ভরিতার স্পর্শ নেই। শৈশবের মতোই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর নিখাদ ভালবাসায়। অবাক হয়েছি যখন এই প্রচারবিমুখ অকৃতদার মানুষটি স্মিত মুখের আড়ালে এক ম্লান বেদনার করুণ সরলতায় বলতেনÑ ‘ঢাকায় তিনদিন আছো, একদিনও বাসায় আপ্যায়ন করতে পারিনি, আজ দুপুরে ঢাকা ক্লাবে লাঞ্চ, ভুলোনা কিন্তু…।’ সে আহ্বান এড়াই কী করে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার হারানো সুরে কচি-কাঁচা মন দোলে উঠে, নীরবে অনুসরণ করি। বিস্মিত হই তাঁর আন্তরিকতায়। মুগ্ধ হয়েছি তাঁর অনুভবে অতীত, অতীত নয় রূপে জেগে থাকায়। চেনা মুখগুলি দীর্ঘ অদর্শন আর সংস্পর্শ দূরত্বের পরও যেন চেনা হয়ে ছিল আপন হাতের তালুর মতোই।
বরাবরের মতো প্রাপ্তিযোগের কৌশল প্রয়োগে অমনোযোগী হাসান শাহরিয়ার কোনো অহমিকায় নয় নিতান্ত অমায়িকতায় কর্মকীর্তির শ্রেষ্ঠত্ব আর তারকাগৌরব ধারণ করে ছিলেন এক বিস্ময়কর অনন্যতায়। আজকের দিনে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক খ্যাতিমানদেরই অন্তত এ বোধটুকু আত্মস্থ করার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। চির সবুজ, চির নতুন প্রিয় শাহরিয়ার ভাই, সময়ের আগ্রাসনভেদী যৌবনের স্পর্ধা নিয়েই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তাঁর অমর কীর্তিতে এবং শুদ্ধ অহংকারে। অন্তরের অন্তস্থল থেকে আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।