:: মো. মশিউর রহমান ::
বৈশ্বিক করোনা মহামারি এখনও শেষ হয়নি। বিশ্বের মানুষ একটি অস্থির সময় পার করছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রবেশ করলেই দেখা যাচ্ছে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই আমরা দেশে-বিদেশে প্রিয়জনকে হারাচ্ছি। গত কয়েকদিন পূর্বে সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার ও তাঁর বড় ভাই সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী, কলামিস্ট হোসেন তওফিক সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভের জন্যে প্রিয়জনরা তাঁদের জন্য দোয়া চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল শনিবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে ফেসবুক খুলতেই চোখে পড়ল সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার আর নেই। নশ্বর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সুনামগঞ্জের এই কৃতী সন্তানকে হারিয়ে আমরা শোকাহত।
সুনামগঞ্জের এই গুণী ব্যক্তি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বলা যায়। আমরা গুণী মানুষকে সময়মতো যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি না। মৃত্যুর পর শুরু হয় গুণকীর্তন আর শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত।
হাসান শাহরিয়ার ছিলেন সাংবাদিকতায় একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি সুনামগঞ্জ জেলা শহরে হাসননগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মকবুল হোসেন ছিলেন তদানীন্তন আসামের প্রথম মুসলিম সম্পাদক, ভাষাসৈনিক, লেখক, রাজনীতিবিদ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক।
হাসান শাহরিয়ার এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর পারিবারিক নিবাস জেলার তাহিরপুর উপজেলার লাউড় পরগণার বিন্নাকুলি গ্রামে। তিনি ১৯৬২ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবীলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রবেশিকা পাস করে সুনমাগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে উচ্চ শিক্ষারজন্য করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি সেখান থেকে কৃতিত্বের সহিত স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুল জীবন থেকেই হাসান শাহরিয়ারের প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। ছাত্র জীবনেই তিনি শিল্প, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। স্কুলে তিনি ও তাঁর সতীর্থ মলয়কুমার ভৌমিক যৌথভাবে ১৯৬০-৬১ সালে স্কুল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। ছাত্র জীবনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতার যাত্রা। ১৯৬৪ সালে করাচিতে মাহমুদ জাওয়াদ সম্পাদিত ‘ডেমোক্রেট’ নামে একটি ইংরেজি রাজনৈতিক সাপ্তাহিকে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি কিছুদিন কাজ করেন। তারপর যোগদেন দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায়। ১৯৬৬ সালে তিনি রিপোর্টার হিসেবে দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকায় যোগদেন। ঐ সময়ে ‘ডন’ এর সহযোগী পত্রিকা সান্ধ্য দৈনিক ‘ইভিনিং স্টার’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। তখন করাচির ‘ইলাস্ট্রেটেড’ উইকলি অব পাকিস্তান’ ও ‘হেরাল্ড’ ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লিখতেন। করাচি যাওয়ার পর ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তান সংবাদদাতা নিয়োগ করে। ১৯৭০ সালের র্নিবাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যান, তখন তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে হাসান শাহরিয়ার ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে করাচি, জেকোকাবাদ, কোয়েটা ও লাহোর ঘুরে ঐতিহাসিক সফরটি কভার করেন।
১৯৯৩-৯৪ মেয়াদে হাসান শাহরিয়ার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি র্নিবাচিত হন। তাঁর হাতে গঠিত হয় কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (সিজেএ)। অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সহিত তিনি এ সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। এ সময়ে তিনি সাংবাদিক হিসেবে বিশ^ব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৪ সালের মার্চে তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্যোগে প্রথম বারের মতো ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় প্রেসক্লাব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলের সাংবাদিকদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় প্রেসক্লাব গঠন করা হয়। তখন হাসান শাহরিয়ারকে নবগঠিত কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। তিনি বৈদেশিক সংবাদদাতা সমিতি ওকাব-এর সভাপতি ছিলে দু’বার ১৯৮৪ ও ১৯৯১ সালে। এতো উঁচু মাপের মানুষটির গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ছিল অধিক। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিজেএ সম্মেলনে তাঁর স্কুল শিক্ষক মু. আবদুর রহীম উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চ থেকে নেমে এসে হাসান শাহরিয়ার তাঁকে কদমবুচি করলে কমনওয়েলথভুক্ত ৫২টি দেশের সাংবাদিকেরা ছাত্র-শিক্ষকের এমন সম্পর্ক দেখে বিমোহিত হন।
হাসান শাহরিয়ার বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেন। বিশে^র বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তিনি বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে তিনটি ভাষণ দেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলেন সদস্য ছিলেন। ১৯৮৭ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ আয়োজিত সম্পাদকদের গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। হাসান শাহরিয়ার ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অঙ্গনে তিনিই ছিলেন প্রথম বিশেষ সংবাদদাতা। সপ্তাহখানেক পর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদ উল্লাহ। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সাথে। ‘মঞ্জু আমাকে বলেছে তুই ইত্তেফাকে জয়েন করেছিস’ এই উক্তি করে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন ‘খুব ভালো করেছিস’ এতে অবাক হলেন সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার। তিনি তাঁর বন্ধুদের বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমার মতো একজন নগণ্য সাংবাদিক কোথায় কাজে যোগ দিয়েছি তা-ও তাঁর নজর এড়ায় না। তিনি নমস্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন অনুষ্ঠান কভার করতেন। এক সময় হাসান শাহরিয়ার শশ্রুমণ্ডিত হয়ে পড়েন।
বঙ্গবন্ধু একদিন হাসতে হাসতে রসিকতা করে তাকে বললেন ‘তুই এক কাজ কর। মাথায় টুপি এবং পাজামা-পাঞ্জাবি পরে গাছতলায় বসে যা। লোকে বলবে ছাওয়াল পীর। মুরিদের অভাব হবে না। আরেকদিন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বললেন ‘অনেকেই আমার কাছে অনেক কিছু চায়। তুই তো কিছু চাইলি না। উত্তরে হাসান শাহরিয়ার বলেছিলেন, ‘আপনার ভালোবাসা পেয়েছি, আর কিছুর প্রয়োজন নেই।’ বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
হাসান শাহরিয়ার ছিলেন চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসান শাহরিয়ারের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্বেও তিনি তাঁর কাছে নিজের জন্যে কিছুই চান নি। এমন কি তাঁর সাথে বিদেশ ভ্রমণেও যাননি। সমকালীন রাজনীতি বিষয়ে তিনি ছিলেন সচেতন। রাজনৈতিক কলাম লিখতেন। রাজনীতি সচেতন হলেও তিনি লেজুরভিত্তিক রাজনীতিতে তিনি নিজেকে জড়াতে চান নি। বঙ্গবন্ধু তাকে ৭০-এর নির্বাচনে দাঁড়াতে বলেছিলেন। ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাও দু’বার তাকে সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে প্রার্থী হতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে জড়াতে চাননি। বন্ধুবৎসল, সদালাপী, প্রচার বিমুখ অকৃতদার হাসান শাহরিয়ার ২০০০ সালে পবিত্র হজব্রত পালন করে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে সাদামাটা জীবন যাপন করছিলেন।
সুনামগঞ্জের মাটিতে জন্ম নেয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার ছিলেন নিজেই সাংবাদিকতার একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর জীবন, কর্ম আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, সুনামগঞ্জের এই কৃতী সন্তানকে মহান আল্লাহ জান্নাতের সর্বোচ্চ চূড়ায় আসীন করুন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্যসূত্র : হাসান শাহরিয়ার, সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তি
[লেখক : প্রভাষক, ইংরজি বিভাগ, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মণ কলেজ, বিশ^ম্ভরপুর]