:: রমেন্দ্র কুমার দে ::
দেশের উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণ ও প্রাপ্তিতে নিশ্চিত করে নতুন ধরিত্রী গড়ার প্রত্যয়ে ২০১৫ সালে জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়ন (এস.ডি.জি) ২০৩০ এজেন্ডা গৃহীত হয়। অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহের মধ্যে “জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও অল্প বয়সী মেয়েদের ক্ষমতায়ন” একটি এজেন্ডা। বাংলাদেশেও এর বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে। দেশে বর্তমানে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা, শিশু নির্যাতন, বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানি ঘটেই চলছে। দেশের সংবিধানে আছে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার কিন্তু আমাদের সমাজ কাঠামো এখনও সনাতনি পুরুষতান্ত্রিক রয়েগেছে। আর সাধারণভাবে মানুষের মনস্তও উন্নত হচ্ছে না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে যদি নারী-পুরুষদের বৈষম্যের অবসান না ঘটানো যায় তাহলে কখনও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। পাচার, যৌন হয়রানি, সকল শোষণ-বঞ্চনাসহ ঘরে-বাইরে সকল নারীর সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে। বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিবাহ বন্ধ করতে হবে। সরকারি সেবা অবকাঠামো ও সামাজিক সুরক্ষা, পারিবারিক পরিমণ্ডলে যুক্তিসঙ্গত অংশগ্রহণে দায়িত্ব পালন, গৃহস্থালি কাজের মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নারীদের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর অংশগ্রহণ ও সমান সুযোগ দিতে হবে। জাতীয় আইন-কানুনের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পদ এবং ভূমিসহ সকল প্রকার সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সেবা উত্তরাধিকার নারীদের সমঅধিকার নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। জেন্ডার সমতা আনয়নে যথাযথ নীতিমালা ও প্রয়োগযোগ্য আইন বিধান প্রণয়ন এবং এগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনায় সমসুযোগ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, উন্নত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিসহ অগ্রমুখী কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে যাচ্ছে। সেই তুলনায় সামাজিকভাবে যদি উন্নতি না হয়; সামাজিক জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন না হয়; সামাজিক নিরাপত্তা যদি না থাকে তাহলে আমরা কি সুখি হতে পারব ?
দেশে নারী নির্যাতন দমন আইন আগে ছিল সাতটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান। এখন নতুন করে ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হল কিন্তু এই বিধান করেও তো দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধের ব্যাপকতা কমছে না। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না দ্রুত সময়ে। তার মূল কারণ হল- তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভুক্তভোগীরা সঠিক বিচার পায় না। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ, প্রসিকিউশন ও কারাগারে ব্যাপক সংস্কার না আনলে এ থেকে উত্তরণ করার সম্ভাবনা কম।
নারী নির্যাতন প্রতিকারের প্রধান সেবক হল পুলিশের ভূমিকা। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সঠিক দায়িত্ব পালন না করায় ভুক্তভোগীরা ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। উন্নত বিশ্বে পুলিশ হল একটা সেবার অংশ। আমাদের দেশে এখনও সেকেলের মত পুলিশকে ধরা হয় “পুলিশ ফোর্স”।
এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে এখন থেকেই স্কুল-কলেজে যাতে শিক্ষার্থীরা নৈতিক শিক্ষা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম একটা বিরাট সংকটের মধ্যে আছে। বর্তমানে তরুণরা সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, কমিউনিটি কার্যক্রম থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তরুণরা জঙ্গিবাদ ও মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকছে। উপযুক্ত সংগঠন নেই। সেসব জায়গায় আমাদের সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছে।
যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার, শিশু অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, বাসযোগ্য পরিবেশের অধিকার, সবকিছু সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জন হয়েছে। কাজেই টেকসই উন্নয়নে (এস.ডি.জি) নারীকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের চিন্তা করা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পোশাকশিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ না হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তো না। নারীরাই একমাত্র কাণ্ডারী হিসাবে শিশু-কিশোরদের শিক্ষা স্বাস্থ্য সঠিক যত্ন নেন। দেখা গেছে নারীরা কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করেন।
[লেখক : রমেন্দ্র কুমার দে, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক]