:: অ্যাড. মলয় চক্রবর্তী রাজু ::
হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা মস্তিষ্কের চিন্তাধারাকে এলোমেলো করে দেয়। ঘটনাটার তীব্রতা যদি বেশি হয় তাহলে এর রেশও অনেক সময় ধরে থেকে যায়। খসরু ভাইয়ের মৃত্যু তেমনি এক ঘটনা। বেশবড় এক জনগোষ্ঠীকে বিশাল এক ধাক্কা দিয়েছে তাঁর মৃত্যু। প্রায় সত্তর বছর জীবনে তিনি যে পরিবার বা আত্মীয় ছাড়া অনেকের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন তা দেখা গেল তাঁর মৃত্যুর পর। আজ পর্যন্ত অনেকে সেই বিহ্বলতা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। সমব্যথী কারো সাথে দেখা হলেই ভারাক্রান্ত মনকে হাল্কা করার প্রয়াস করছেন বিভিন্নভাবে। তাঁকে নিয়ে ব্যক্তিগত বা সামাজিক কোন স্মৃতিকথায় সজল হয়ে উঠছে চোখ। এতো শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা জীবনের আকস্মিক এ অবসান কেউই মেনে নিতে পারছেন না।
জীবনের সবক্ষেত্রেই শৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। সংকোচতাকে পছন্দ করতেন না। যা বলতেন সরাসরি। সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন খুব তাড়াতাড়ি। আমি নিজেও তাঁর এই গুণটা খুব কাছে থেকে দেখেছি ছোটবেলায় বা বড় হয়েও। দৃঢ়তা, সততা, নিজের মতের প্রতি অটল থাকা ইত্যাদি গুণের কারণে তাঁর প্রতি মানুষ আকর্ষিত হতো। এজন্য তিনি যেখানে থাকতেন তাঁর একটা ফলোয়ারস্ গড়ে উঠতো। পেশার ক্ষেত্রে যারা তাঁর জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন যেমন অ্যাড. সালেহ আহমদ, অ্যাড. আ. হামিদ, অ্যাড. বিশ্বজিত চক্রবর্তী, অ্যাড. মুজিবুর রহমান, অ্যাড. আব্দুল মজিদ জুয়েল, অ্যাড. সবিতা চক্রবর্তী, অ্যাড. আমিন – তাঁরা আমৃত্যু তাঁকে শিক্ষকের মতো শ্রদ্ধা করেছেন।
আমার সবচেয়ে বড়ভাই অ্যাড. মৃণালকান্তি চক্রবর্ত্তী’র (ভাইবোনেরা ডাকতাম দাদাবাবু – সংক্ষেপে দা’বু) বন্ধু ছিলেন। ছোটবেলায় প্রায়দিনই দেখতাম তাঁকে দা’বুর ঘরে। এই ঘরটা ছিল একটা ক্লাবের মতো। সারা সময় তাঁদের সমবয়সীদের আড্ডায় মুখরিত থাকতো। বামধারার ছাত্র রাজনীতির একটা কেন্দ্র ছিল আমাদের বাসা। খসরু ভাইয়ের রাজনীতিও ছিল এ ধারার। এই ধারার রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক একটা আবহ সবসময় বহমান থাকতো বাসায়। কাজেই সাংস্কৃতিক আর বাম রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষের আনাগোনায় মুখর থাকতো আমাদের বাসা।
দুটি ধারারই সম্মিলনে বেড়ে ওঠা খসরু ভাইয়ের উপস্থিতিটা তাই দা’বুর বন্ধুদের মধ্যে কিছুটা বেশিই ছিল মনে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর গলার স্বরই বেশি শোনা যেতো। দা’বুও দেখতাম সে সময় বা পরবর্তীতেও খসরু ভাইয়ের সিদ্ধান্তকে খুব মূল্য দিতো। আমরা সব ভাই-বোনেরা খসরু ভাইকে আমাদের পরিবারের একজন বলে মনে করতাম।
আমার তখন ছোটবেলা- হঠাৎ জানলাম বিদেশ চলে গেছেন। কিছুদিন পর তাঁর চিঠি আসা শুরু হলো দা’বুর কাছে। সেসময় দা’বুর বন্ধুদের মধ্যে মোসাদ্দেক ভাই আর খসরু ভাইয়ের চিঠি পড়া আমারকাছে খুব প্রিয় ছিল। কারণ সাথে থাকতো তাদের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। আমি লুকিয়ে অথবা দা’বুর সম্মতিতেই চিঠিগুলো পড়তাম। দু’ধরনের স্বাদ পাওয়া যেতো তাদের দু’জনের চিঠিতে। খসরু ভাইয়ের চিঠিতে থাকতো গল্পের মতো তাঁর সেখানকার জীবনযাপনের কথা এবং নিয়মিত চিঠিগুলো আসায় তার একটা ধারাবাহিকতা থাকতো। চিঠিগুলো ছিল কয়েক পাতার আর সাথে সহকর্মী বা বিভিন্ন জায়গার ছবি। আমার কল্পনাপ্রেমী মন দূরে ডানা মেলতো চিঠিগুলোর বর্ণনার সাথে সাথে।
আমি তখন কলেজে, খসরু ভাই স্বদেশে ফিরে এলেন। এসেই বিভিন্ন রাজনৈতি-সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত হতে থাকলেন। দেখলাম বিগত ৫বছরের যে গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর শহরের মানুষের সাথে তা পূরণ হতে শুরু হলো। সেসময়ের পদক্ষেপগুলো পরে যখন পর্যালোচনা করি তখন বাস্তবতার নিরিখে এখন এগুলোর যথার্থতা অনুধাবন করতে পারি। ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ না থাকায় তাঁর জীবনের সিদ্ধান্তগুলো খুবই বাস্তবতার সাথে মিল রেখে নিতে পেরেছেন বলেই তিনি সফল হতে পেরেছিলেন। তাই কি ব্যক্তিগত কি সামাজিক জীবন-সবক্ষেত্রেই খসরু ভাই সাফল্য পেয়েছেন।
তাঁর এক পুত্র আর এক পুত্রী দু’জনেইপরিণত। স্ত্রী কবি, সাহিত্যমনা। ভাইয়েরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বোনদের বিয়ে দিয়েছেন যোগ্য পাত্রের কাছে। স্বজনদের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত বাড়ানো থাকতো। সবাইকে নিয়ে সুখী হওয়ার একটা প্রবণতা তাঁর মধ্যে দেখতাম। দশ-এগারো বছর আগে হবে। আমি তখন তাঁর চেম্বারে জুনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করি। সেদিনও কাজ করছি, তিনি ইন্টারনেটে ব্রাউজিং করছেন। হঠাৎ ভারত সরকারের মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়েদের স্কলারশিপ দেয়ার ঘোষণা তাঁর চোখে পড়লো। তখনই খাম আনালেন আর উজির ভাই (মুক্তিযোদ্ধা-তাঁর সম্পর্কীয় ভাই)কে দিয়ে এ সংক্রান্ত খবরটি লিখে খামে ভরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার দায়িত্ব আর ভালবাসা প্রকাশে তিনি অসংকোচ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ভালবাসতেন। সবসময় মুক্তিযুদ্ধ বা এর সাথে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করতে উৎসুক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দুইজন রাজনৈতিক নেতা কমরেড বরুণ রায় ও আলফাত উদ্দিন (মোক্তার সাব)কে নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন। অনেক শ্রম আর সাহসিকতা জড়িয়ে আছে বইটি প্রকাশের সাথে। একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে জাহির করতেন না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব ধরনের কাজে তাঁর উৎসাহ ছিল চোখেপড়ার মতো। ‘মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা ছিল এ কারণেই।
স্বাধীনচেতা ছিলেন। চিন্তাধারা বা কার্যপ্রক্রিয়ার সাথে মিল না হলে কোনকিছুতে অংশ নিতেন না। প্রতিবাদ করতেন বা নীরব তাচ্ছিল্য দেখাতেন। সেজন্যই বামধারায় দীক্ষিত খসরু ভাই মূলধারার রাজনীতি করেননি। তৃতীয়ধারাতেই আকর্ষণ বোধ করতেন। অনেক প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল। তাই যে সংগঠন বা সংস্থার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তার বিকাশ ঘটিয়েছেন। সর্বশেষ ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’। স্থানীয়ভাবে এর বিস্তার ঘটানো তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতারই ফল। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, ভোরে হাঁটতে পছন্দ করতেন। এটাকে একটা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে এনে বেশ একটা আলোচিত আমোদের বিষয় করে ফেলেছিলেন। এই ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে অ্যাড. স্বপন দাস রায়, অরুণ দে, সনত দাস, আ. মতিনসহ অন্যান্যরা এখনো শোকগ্রস্ত।
আসলে খসরু ভাই মারা যাওয়ার পর অনেক বিষয়ের দিকে দৃষ্টি চলে যায়। যেমন, আইনজীবী সমিতি আর শহরের সুশীল সমাজের সাথে গ্রহণযোগ্য এক সেতু হিসেবে তার অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। শহরের পুরনো বাসিন্দা হওয়াতে তাঁর এই সুবিধাটা ছিল। আইনজীবীরা তো তাঁর পরিবারের মতোই; শহরের পুরনো পরিবার বা অন্য পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এমন সব ধরনের মানুষের বা পরিবারের ব্যাপারেও তাঁর সম্যক ধারণা থাকায় সবাইকে নিয়ে কাজ করাও তাঁর জন্য সহজ ছিল। তার উপর ব্যক্তিত্ব আর সততার জন্য অনেক বাধাকে অতিক্রম করা তাঁর জন্য সহজসাধ্য ছিল। এভাবে আরও অনেক বিষয় যা হয়তো তাঁর সম্পর্কে আলোচনায় উঠে আসবে। আশা করি তাঁকে যারা ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন তাদের উদ্যোগে বজলুল মজিদ খসরু আরও স্পষ্ট হয়ে সবার চোখে ফুটে উঠবেন।
সাংবাাদিকতা, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কি ভূমিকায় ছিলেন বা সফল হয়েছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে।
যে কথাগুলো দিয়ে শুরু করেছিলাম অর্থ্যাৎ ‘অবিন্যস্ত চিন্তাধারা’ই খসরু ভাইকে নিয়ে এ লেখাকে শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত করেছে। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর জীবনকে সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে তাই বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে শোকসন্তপ্ত মনের কারণে। তবুও নিজের শোক আর শ্রদ্ধা প্রকাশের আর অন্য কোনো উপায় এ মুহূর্তে আমার কাছে নেই।
বিজ্ঞান বলে, প্রাণ আছে এমন কোন জীবের জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। আবার বলা যায় মৃত্যু জীবনের শেষ নয়। একটি শারীরিক মৃত্যুর পরও তাঁর আদর্শিক জীবনের একটি প্রবাহ বয়ে চলে। বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু যে একটি আদর্শ নিয়ে পথ চলতেন সে পথে আরও জীবন অংশ নেবে। আর এভাবেই সেই জীবনের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন।