“জাতক তাঁর স্বক্ষেত্রে মেধা ও খ্যাতির প্রায় শীর্ষে অবস্থান করিবে। অসংখ্য গুণগ্রাহীর সাথে সাথে যথেষ্ট সংখ্যক নিন্দুক ও তাঁর জীবন চর্চায় মুখর হইবে এইরূপ জ্ঞাত হয় এবং সম্মানের শীর্ষ স্থলে পৌঁছানোর দ্বারপ্রান্তে অবস্থানকালীন ক্ষণেই তার আয়ু রেখার দৈবাৎ পতন লক্ষ্য করা যাইতেছে।”
ভূমিকাংশে উল্লেখিত (কোষ্ঠী গণনায় প্রাপ্ত) সেই অদম্য মেধা আর প্রবল সদিচ্ছায় প্রাণবন্ত জাতকটি আর কেউ নন, আমার-আমাদের “গানমামা”। মামার সাথে বড়, মেজ, সেজ বা এ জাতীয় বিশেষণই বেশি গ্রহণযোগ্য ও মানানসই ঠেকে। কিন্তু আমার এই মামা ঐসব বিশেষণের বাইরে একান্তই নিজের যোগ্যতার ভিত থেকেই বোধকরি নিজের অজান্তেই পরে নিয়েছেন এই “গান” বিশেষণটির তকমা। আর এ বিশেষণে বিশেষায়িত করার ইতিহাস নিয়ে আমি নিজেকে ভীষণ গর্বিত ভাগ্নি অনুভব করি।
কেবলমাত্র তাঁর গানের প্রতি অসীম আগ্রহ ও চর্চার একনিষ্ঠতা দেখেই হয়তোবা ছোটবেলার সেই ছোট্ট আমি অন্তর্নিহিত অর্থ না বুঝেই কী ভীষণ যথার্থ বিশেষণে তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছিলাম ভেবে এখন পুলক বোধ করি। সঙ্গীত তথা গানের সাথে মিলে মিশে একাকার আমার এই গানমামাকে নিয়ে আমার স্মৃতি অফুরন্ত, যা কেবলই সুখের দোলায় দোদুল্যমান। প্রায় সকলের মতই ছোটবেলায় মামার বাড়ি ছিল আমার আর আমার ছোট ভাইয়ের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও একক পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে বার বার গিয়েও যেন “পরাণের” আশ মেটানো যেতো না। দাদুভাই, দিদা, মামা-মাসীদের ভিড়ে তখন আমার সেই গানমামাকে মনে হতো কিছুটা অন্য প্রজাতির, ঠিক ততটা হাস্য রসিকতায় ফেটে পড়া যেমন তাঁর স্বভাব ছিল না, তেমনি গোমড়ামুখো, হুতুম পেঁচা কিংবা ক্রোধান্মগ্ন দুর্বাসা ঋষির মতও তিনি ছিলেন না। কেমন এক অন্যরকম উদাসী মগ্ন হৃদয়, যেখানে ভালোবাসার বিশাল নদীটাকে যেন একটু আড়াল করে রাখতো ছোট ছোট পাহাড় আর মাঝে-মাঝেই সেই নদীর উত্তাল ঢেউ পাহাড়গুলোকে ছাপিয়ে এসে সিক্ত করে দিত আমাদের…
এমনি উপলব্ধি আমার। মামা বাড়িতে ছুটি ছাটায় বেড়াতে গেলে আমার একমাত্র বিরক্তির কারণই ছিল এই গানমামা কিংবা ছোট মাসির কাছে বসে গান শেখা। এক্ষেত্রে গানমামা’র বিষয়টা ছিল মোটামুটি অত্যাচারের সামিল। নির্ভুল গান গাইতে পারার আগ পর্যন্ত ছুটি মিলত না সেখানে, এ ব্যাপারে একেবারেই হড়-আপোস। আবার সমস্ত অতিকাক্সিক্ষত উপহার পাওয়ার ও একমাত্র স্থল ছিলেন গানমামা। মনে পড়ে, গানমামা শান্তি নিকেতনে তাঁর পি এইচডি’র কাজে ব্যস্ত থাকার সময়ে মাঝে-মধ্যে বাংলাদেশে আসলেই আমাদের দেখতে সুদূর সুনামগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে আসতেন। সঙ্গে আসতো উপহারের জোয়ার। নিজের বৃত্তির টাকা জমিয়ে উপহার কিনতেন সবার জন্য। যাক, এভাবে ছোটবেলা পেরিয়ে বড় বেলায়ও তাঁর সাহচর্য পেয়েছি অনেক। পেয়েছি সবক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় সাহায্য ও নির্ভরতা। গান মামার আরেকটি বড় গুণ যেটা আমি দেখেছি তা হচ্ছে তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণের সামর্থ। ব্যক্তি জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি হয়তো ছিল তাঁর, সমাজ জীবনেও এই প্রাপ্তির আশা কম ছিল না। স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে তাঁর নাম প্রায় ঘোষিত হয়েও শেষ পর্যন্ত হল না, এ দুঃখ জীবনের শেষদিন পর্যন্তই বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু কখনই বুঝতে দেননি। মনে পড়ে আমার বিয়েতে তাঁকে মানুষের ভিড়ে বিয়ের আগের দিনে একবার দেখেছিলাম। আমি খেয়েছি কিনা, শাড়ি পরে জবুথবু হয়ে বসে গরমে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি কিনা, তাঁর খবর নিতে আসতে, আর দেখি আমার কনে বিদায় পর্বে। কিভাবে কিভাবে যেন আমার সেই মুখচোরা, লাজুক স্বভাবের মামাটি এত লোকের ভিড় কাটিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাকে নিয়ে যেতে আসা বর কনের গাড়িটির পাশে। গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখে সান্ত¦না দিয়ে যাচ্ছিলেন “এই তো দুইদিন, পরেই তো আবার ফিরা যাত্রায় আসবি! ছি ছি কাঁদিস না, আমরা তো সবাই আছি, ভয় কিসের!?”
বাংলাদেশ এ সংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে জীবনে কম পরিশ্রম করতে হয়নি তাঁকে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিশ্রম সার্থকতার ছোঁয়া পেয়েছিল। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সঙ্গীত একটি আলাদা, উরংপরঢ়ষরহব এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সংগীত নিয়ে গবেষণা করা যায়, নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করে এতে সুরের খেলা পর্যবেক্ষণ করা যায়, তা আমার বোধগম্য হতনা, আমার এই গানমামাটিকে না দেখলে। ঢাবিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর বহুল জনপ্রিয়তা আমাকে অবাক করে। আমি প্রায়ই, ভাবি আমার এই বাকসংযম, ঋষিসুলভ চেহারার দার্শনিক স্বভাবের মামা কেমন করে তাঁর মৌনতাকে ছাপিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রাণে প্রবল গুরুপ্রীতির মূর্ছনায় তীব্র বেগে বেজে ওঠার ক্ষমতায় বলীয়ান হলেন!!!
ঘুরে ফিরে আবার এল ১৫ই আগস্ট। এমনই এক দিনে তিনি হারিয়ে গেছেন… জানিনা কোন ঠিকানায়! পৃথিবী যতদিন আছে, যতদিন আছে বাংলাদেশ আসবে ১৫ই আগস্ট, কিন্তু ফিরে আসবে না আর কখনো আমার গানমামা। হয়তো হাজার ঝকমকে, রঙিন গল্পে সাজতে- সাজতে ফিকে হয়ে আসবে আমার গানমামার কীর্তির ইতিহাস, থাকবে না কেউ তাঁর কথা বলার জন্য (যেমন ধীরে- ধীরে তা কমে আসছে তাঁরই হাতেগড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সেই প্রাণের মতনই প্রিয় সংগীত বিভাগের পরিসরেও) তাঁরই প্রদত্ত গুরুমুখী বিদ্যায় পরিপুষ্ট কণ্ঠে হয়তো বেজে উঠবে তাঁরই উদাত্ত, সুরময় গানের দরাজ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, কেবল অনুচ্চারিত থাকবে একটি নাম, একটি অর্ধ সমাপ্ত পৃষ্ঠার দীর্ঘশ্বাস .. “ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী’।
ভালো থেকো গানমামা, যেখানেই থাকো। গানের উন্মাদনায়, সুরের মূর্ছনায় মিলে মিশে একাকার হয়ে থেকো ¯স্রষ্টার পরম যত্নের আশ্রয়ে। তোমার জন্য কিছু করা হবে না হয়তো এ জনমে, তবু জেনো, যতদিন বেঁচে থাকবো আমরা… তোমার নিকটজনেরা সবাই… সবাই মনে রাখবো তোমার কীর্তি, সরবে না হোক, নীরবেই ঝরবে অসংখ্য চোখের জল, তোমার স্মৃতির রোমন্থনে…।