1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ০৪:১৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় চাই

  • আপডেট সময় শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০

:: রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু ::
কিছুদিন আগে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’-এর দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার সম্মেলন হয়ে গেল। সম্মেলনে তারা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে হাওর অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য। হাওর অঞ্চল নিয়ে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি নেত্রকোণাবাসীও জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে সরকারের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মন্নান হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা কতটুকু য্ুিক্তযুক্ত তা অবশ্যই অনুধাবন করেন।
হাওর অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোণা। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হাওর অঞ্চলের জনগণ সার্বিকভাবে পিছিয়ে আছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে টিকে আছে। অথচ এই হাওর অঞ্চলের বোরো ফসল, মাছ, বালি-পাথর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখে চলছে।
প্রতি বছর ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয় হাওরাবাসীদের। কোন কোন বছর অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যায় এর জন্য অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে দিন কাটাতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক সংকটে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। বছর বছর ঋণ করে কৃষকরা যে ফসল ফলায় তার উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ ও সারা বছর অর্থ সংকটের মধ্যে থাকতে হয়। আর কোন কোন বছর ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকদের যে দুর্দশা তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সকল কৃষকের তো জমি নেই। তারা অন্যের জমিতে শ্রম দেয় বা বর্গা চাষ করে। কাজেই তারা সারা বছরের জন্য ঘরে ফসল তুলতে পারেন না। যা পায় তা দিয়ে কয়েক মাস চলে, তারপর বেকার।
এবার করোনা পরিস্থিতিতে দেশের বহু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং হারাচ্ছেন। দেশে নতুন করে ২০% মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন – বলে গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে। তার প্রভাব এত তাড়াতাড়ি যাবে বলে মনে হয় না। এতদিন গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে যেত। এখন শহরেও কাজের অভাব।
২০১৭ সালের পূর্বে ফসলরক্ষা বাঁধের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সুনামগঞ্জে হাঁওর বাঁচাও আন্দোলন নামে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠার পর বাঁধের কাজ অনেক বেশি হয়েছে এবং দুর্নীতি কিছুটা কমেছে।
আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে সুুখি নিরাপদ সমাজের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চেয়ে ছিলাম। আমরা কি সে লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছি? এখনও আমরা বাঁচার জন্য লড়াই করছি। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছি। দিন দিন বৈষম্য বাড়ছে। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের নিকট সম্পদ কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন বাংলাদেশে ৫ ভাগ মানুষের কাছে দেশে ৯৫ ভাগ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর এক নম্বর কোটিপতি উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশ ২০২০ সালে আশা করছে জি.ডি.পি ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। বাংলাদেশে মাথাপিছু ২০২০ সালে হবে ১ হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কে না চায়? দেশে দিন দিন মানুষ কর্মহীন হচ্ছে। নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সুফল প্রত্যেক মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উপর নির্ভর করে। দেশের গুটিকয়েক মানুষের নিকট লাখ-কোটি টাকা দখল করে গড়ে ষোল কোটি মানুষকে নিঃস্ব করে রেখে মাথাপিছু আয় বেশি দেখালে তো গরিব মানুষের পেট ভরবে না।
দেশ স্বাধীন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল দেশ হবে গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন যা মানুষের কাজে লাগে।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ইং সুনামগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগারে এসডিজি অর্জন উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্যানক্রেডের উদ্যোগে জেলা নেটওয়ার্ক এক সভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য বিলোপ, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, মানসম্মত শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, অসমতা হ্রাস, টেকসই নগর ও জনবসতি, পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন, জলবায়ু কার্যক্রম, জলজ জীবন, স্থলজ জীবন, শান্তি-ন্যায় বিচার এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান, অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারিত্ব। সুনামগঞ্জে এর মধ্যে ৬টি এজেন্ডাকে লক্ষ্য করে তাহিরপুর এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে।
হাওর অঞ্চলের জনগণ অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে আছে। তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক, শিক্ষার ক্ষেত্রেই হোক বা যোগাযোগের ক্ষেত্রেই হোক, সার্বিক দিক থেকে পিছিয়ে আছে। এই এলাকার মানুষ দিতে জানে, ভোগ করতে জানে না। এ এলাকার ধান-মাছ সারাদেশই ভোগ করে। সুনামগঞ্জের বালি, পাথর সারাদেশে যায়। কিন্তু কৃষক তার ধানের ন্যায্য মূল্য পায় না, মৎস্যজীবী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করবে সে সুযোগও পায় না। কাজেই হাওর অঞ্চলের উন্নয়ন করতে হলে পৃথক মন্ত্রণালয় করে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম হাতে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিত্যাগ করে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিলে অবশ্যই সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। এ এলাকার বোরো ধান উঠার সঙ্গে সঙ্গে যাতে ন্যায্য মূল্য পায় সেজন্য সরকার যদি ধান সংগ্রহ করে তাহলে ঋণগ্রস্ত কৃষক উপকৃত হবে এবং ন্যায্য মূল্যও পাবে। এর জন্য প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা। এতে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য থেকে কৃষক মুক্তি পাবে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই কৃষির পাশাপাশি অন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এলাকার উন্নয়নে প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার। সকল শিশু-কিশোররা শিক্ষার আলো পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে হাওর এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের অবদান না থাকলে ফসল ঘরে ওঠানো সহজ হত না। অনেক পরিবার আছে নারীরা রোজি-রোজগার করে সংসার চালায়। কিন্তু সমাজে নারীদের ভোগের পাত্র হিসেবে দেখা হয়। অপরদিকে দেশে নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। তার প্রধান কারণ হল ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। সেটা মূলতঃ তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণ। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া তা দূর করা যাবে না। তাছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্ম রয়েছে বিরাট সংকটে। উপযুক্ত সংগঠন পাচ্ছে না। স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না। এলাকার উন্নতি চাইলে নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের হাওর-নদীগুলো পলিতে ভরে যাওয়ার জল প্রবাহ কমে যায় অকাল বন্যায় আক্রান্ত হয়। মৎস্য উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ও যাচ্ছে। ইজারাদাররা কোণাজালে (মশারি জাল) ব্যবহার করে এবং সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করে পোনা মাছটাও মেরে ফেলে। এতে মাছের বংশ বৃদ্ধি হয় না। সাধারণতঃ চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাছ ডিম পারে। এই প্রজননকালীন সময়ে মাছ মারা নিষিদ্ধ করলে মাছের বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য হত। বর্ষাকালীন সময়ে মাছ নদী থেকে হাওরে আশ্রয় নেয়। কাজেই হাওর যদি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা যায়, তাহলেও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এর জন্য প্রয়োজন হাওরের কান্দায় (উঁচু জায়গায়) হিজল-করচ গাছ লাগানো। এতে জলবায়ুর উপকারে আসবে। এইসব গাছের ডাল-পালা হাওরে ফেলে মাছের আশ্রয় ও শেওলা জাতীয় খাবার উপকারে আসে। হাওরের বসতি গ্রামগুলো এক একটা ছোট ছোট দ্বীপের মত। বর্ষার আফালের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রতি বছর এলাকার মানুষ বাড়ি ঘর রক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও ব্যয় করে। যদি প্রতি গ্রামের সামনে ও পেছনে বেশি করে হিজল-করচ গাছ লাগানো যায় এবং সরকারি উদ্যোগে বাড়ি রক্ষার জন্য ব্যয় করে, তাতে গরিব কৃষকদের উপকার হত।
হাওর অঞ্চলে এসব সমস্যা দূর করতে হলে দেশের পঞ্চায়েতি উন্নয়নের মত আচরণ কোন দিনই কাজে আসবে না। হাওরবাসী যেভাবে দেশকে দেয় সরকারের উচিত তাদের প্রতি ও দেশের উৎপাদনে আরও বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে (এসডিজি) হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রার উন্নয়নের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য ‘হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ আরম্ভ করা। এতে দেশের সার্বিক দিক থেকে বঞ্চিত মানুষজনের উন্নতিতে বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে।
[রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু : প্রাক্তন রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com