1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ০৬:০০ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

প্রাণের আলোয় অভিবাদন : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০

করোনার তীব্র ছোবল। এফোড় ওফোড় হয়ে যাওয়া বিশ্ব। ব্যস্ত নগরীর স্তদ্ধ জীবনে মৃত্যুর কোলাহল। পৃথিবীর দিনলিপি ভরপুর মৃত্যু সংখ্যায়। মানবজাতির সামনে জীবন জয়ের এক মরণযুদ্ধ। এ বিভীষিকাময় যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক, মিসাইল, অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান, সাবমেরিন, টর্পেডো সব অকেজো, অপ্রয়োজনীয়। কড়াল করোনার চোখে চোখ রেখে জীবন বাজি রেখে একটা স্টেথো, থার্মোমিটার, সিরিঞ্জ হাতে সামনাসামনি যুদ্ধ করবেন যাঁরা তাঁরা চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী আর যারা সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, সামলাচ্ছেন সবকিছু। এই যোদ্ধাদের আমরা সহায়তা দিতে পারি -আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা দিয়ে, সহানুভূতি দিয়ে আর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। আমরা ডাক্তারদের দোষ দিতে পারি, সমালোচনা করতে পারি, গালিগালাজও করতে পারি। কিন্তু দোষ কি চিকিৎসকের একার। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, সর্বোপরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। হাসপাতালগুলি যুগযুগ ধরেই অসুস্থ। যারা দেশ পরিচালনা করেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন, জনপ্রতিনিধি- তাদেরই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকায় বিদেশে চিকিৎসায় আগ্রহী। দেশে কি মেধাবী চিকিৎসকের কমতি আছে? সেবাপরায়ণ মানসিকতার ঘাটতি আছে? স্বাস্থ্য খাতে কি হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয়, দুর্নীতি হয়নি। ঠিকাদারের ইচ্ছানুযায়ী যন্ত্রপাতির তালিকায় স্বাক্ষর না করায় হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসককে তাৎক্ষণিক বদলির নজির রয়ে গেছে নিকট অতীতে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাই চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতাল বিমুখ চেম্বার নির্ভর, প্রাইভেট ক্লিনিক নির্ভর করে তুলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো সেবা বিমুখ, বাণিজ্যিক। সেটিও ঢালাওভাবে বলা অনুচিত। অগণিত সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গাটুকু এখনও আমাদের এই জরাগ্রস্ত হাসপাতাল আর আমাদের চিকিৎসকেরা। আমজনতার স্বাস্থ্যের জিম্মাদার তাঁরাই যারা স্বাভাবিক অবস্থাতেই স্বাছ্যন্দ সেবার ছয় গুণ অতিরিক্ত দিয়ে থাকেন। ইউরোপ আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের থেকে শতগুণ উন্নত হওয়ার পরেও সেখানে কী বিপর্যয়টাই না ঘটে চলছে। ন্যুয়র্কে হাসপাতালে জায়গা নেই, মর্গে লাশের স্তূপ, স্থানাভাবে চলছে গণকবর। চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, সোস্যাল ওয়ার্কারসহ অধিকাংশ ম্যাডিকেল বিভাগের ৪০ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত। বাকিরা ব্যস্ত রোগী আর মৃত্যু নিয়ে। এস্টোরিয়ার একটি বাড়িতে এক ব্যক্তির মৃতদেহ স্ট্রেচারসহ প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়ে ওষুধ ছিটিয়ে দরজা আটকিয়ে চলে গেছেন স্যোসাল ওয়ার্কাররা। মর্গের লাশবাহী গাড়ি ব্যস্ত। কিছু মৃতদেহ মাটি চাপার পর জায়গা খালি হলে পরে এসে লাশ নিয়ে যাবে। অন্য রুমে আটকা পড়ে আছেন ওই ব্যক্তির আক্রান্ত দুই সন্তানসহ তাদের জননী। অপেক্ষা, কখন স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যাবে নাকি তার আগে তারা নিজেরাই লাশ হবেন।
ইতালিতে চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য সেবাকর্মীরা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। শতাধিক মৃত্যুবরণও করেন। তাদের যথেষ্ট সুরক্ষা দেয়া যায়নি। বিপর্যয় ঘটে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। লাশের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী অসহায় কেঁদেছেন। তবুও মৃত্যুপুরীর আতঙ্ক অগ্রাহ্য করে ইতালির নাগরিকেরা করোনা যোদ্ধা চিকিৎসক, সেবাকর্মীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আলো জ্বালিয়েছেন বাড়ি বাড়ি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিউগল বাজিয়েছেন, মর্ম বেদনা একপাশে সরিয়ে গান গেয়ে হাততালি দিয়ে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
ইংল্যান্ডের অনেক হাসপাতালকে প্রস্তুতি নেবার আগেই বাধ্য করা হয় করোনা চিকিৎসায়। চিকিৎসা কর্মীরা পিপিই’র অভাবে গার্বেজ ব্যাগে নিজেদের জড়িয়ে আত্মরক্ষা করে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। বৃটিশ বাংলাদেশী যে ডাক্তার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এর কাছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগে খোলাচিঠি লিখেছিলেন সে চিকিৎসকও কোভিড ১৯ এর ছোবলে লাশ হয়ে গেছেন। বৃটিশ এম,পি সরকারি দল, বিরোধী দল, যারা আগে চিকিৎসা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন রাজনীতিকে একপাশে রেখে গলায় স্টেথো, হাতে সিরিঞ্জ তুলে নিয়েছেন।
¯েপনে ভাইরাসে আক্রান্তের দশ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। ফলে সংকট ঘনিয়েছে চিকিৎসায়। প্রাইভেট হাসপাতালগুলি সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। স্টেডিয়াম, কনফারেন্স হলকে বানানো হয়েছে হাসপাতাল। হলে কি হবে চিকিৎসকদের অনেকেই আইসোলেশনে নয়তো আক্রান্ত। মেডিকেল পড়–য়া ছাত্রদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে কাজ চালানোর জন্য। চিকিৎসা সুরক্ষাসামগ্রীর অভাবে শতাধিক ডাক্তার-নার্স আক্রান্ত হয়ে পড়ায় রোমানিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এ যুদ্ধে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে চিকিৎসাকর্মীরা। পেছনে সংক্রমণের আশঙ্কা সামনে কোভিড ১৯ রোগী। ডাক্তার -নার্সরাই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী। কেউ কারো নয়। স্বজনরা পালিয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে রোগীও পালায়। এ এক নুতন অভিজ্ঞতা। আমেরিকার এক হাসপাতাল থেকে করোনা আক্রান্ত রোগী দৌড়ে পালালে দু’জন ডাক্তারকে পেছন পেছন দৌড়ানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। আমাদের দেশে এমন পলায়নের একাধিক ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন। রোগীর মনোবল বাড়াতে মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডাক্তার, নার্সরা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বাজিয়ে নেচে গেয়ে রোগীদের আনন্দ দিতে দেখা গেছে। তবুও মুম্বাইয়ের হাসপাতাল থেকে নিজের পোষাক দিয়ে দড়ি বানিয়ে জানালা ভেঙে পালিয়েছে রোগী। কোভিড ১৯ এর ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ, নার্সদের সযত্ন সেবায় অনেকেই সেরে ওঠে। শেষ ভরসা ভেন্টিলেশন। আমেরিকাতেও যেটির তীব্র অভাব। আমাদেরতো বলার মত নয়। অভাব রয়েছে আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণের। ঢাল-তলোয়ারবিহীন চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা ছাড়াই ঠেলে দিতে চাচ্ছি যুদ্ধক্ষেত্রে। তাদের মনোবল বাড়ানোর, তাদের ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। আমরা বাড়িতে কর্মহীন বসে থেকে অস্বস্তি বোধ করি, হতাশা বোধ করছি। উপজেলার কোথাও একজন করোনা আক্রান্তের খবর শুনে আতঙ্কিত হচ্ছি। আর চিকিৎসককে পাশে থেকে সেবা দিতে হচ্ছে। তিনি রোগীর কাছে থাকবেন কিন্তু যেতে পারবেন না তাঁর সন্তানের কাছে, স্বজনদের কাছে। এই করোনাকালে তাঁকে থাকতে হবে বিচ্ছিন্ন। আমরা নিজ গৃহে থাকতে পারছি না। আর চিকিৎসকরা ঘরে ফিরতে পারছেন না। তাদের মন-মানসিকতাও বুঝতে হবে। পরিবারের দিকটাও ভাবতে হবে। কোনো পিতামাতা তাঁর সন্তানকে, কোনো সন্তান তাঁর পিতামাতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে নিঃশঙ্ক থাকতে পারে না। বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে অন্য কোনো যুদ্ধেই এমন বিপজ্জনক কোনো সেক্টর ছিলো না।
আমাদের বাঁচার জন্য, মানব জাতির সুরক্ষার জন্যই চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীদের সুরক্ষা প্রয়োজন। একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হলে তাঁর সহযোগী, সহকর্মীসহ কয়েকজনকে যেতে হবে কোয়ারেন্টাইনে। তখন চিকিৎসা সেবাটা কে দেবে। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশেও ডাক্তাররা, চিকিৎসাকর্মীরা আক্রান্ত হতে শুরু করেছেন এবং দু’একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। এ সংখ্যাটা যদি বাড়তে থাকে তখন কি বিপর্যয়টা নেমে আসবে তা ধারণার অতীত। যতদিন যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ঘন জনবসতির দেশে এর পরিণতি অনুমেয়। মানুষ এখনও সচেতন নয়। সামাজিক দূরত্ব কঠোর করার পাশাপাশি চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। মুম্বাইয়ের বিলাসবহুল তাজ হোটেলসহ ছয়টি আন্তর্জাতিকমানের হোটেল টাটা গ্রুপ করোনা চিকিৎসাকর্মীদের আবাসনের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। এমন বিলাস বহুল না হোক করোনা ইউনিটের চিকিৎসা কর্মীদের জন্য আমাদের দেশে যেনো এমন আবাসনের ব্যবস্থা করা হয় সরকারিভাবে। সুস্থ মন সুস্থ দেহে তাঁরা যেনো ব্রতী হতে পারেন মহান ব্রতে। আর আমরা যারা সরবে নীরবে স্ব উদ্যোগে মানবতার সেবায় সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছি তাঁরা যেনো চিকিৎসকদের পরিবারের পাশেও দাঁড়াই। চাল ডাল হয়তো দিতে হবেনা তাঁদের খোঁজখবর নেই। সাহস যোগাই, সাহায্যে এগিয়ে যাই। আমিও আছি, আপনিও থাকুন।
চিকিৎসাকর্মীদের প্রতি সংহতি জানাই। আলো জ্বালিয়ে না হোক, বিউগল বাজিয়ে না হোক – আমাদের প্রাণের আলো জ্বেলে রাখি তাঁদের উদ্দেশ্যে, আমরা তাদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করি অন্তর থেকে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com