শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। কিন্তু ওই অগ্রগতি আমাদের সামাজিক অগ্রযাত্রাকে কতখানি প্রভাবিত করতে পেরেছে, এ প্রশ্ন এখনো করা যায়। যে সমাজে এখনো বাল্যবিয়ের আয়োজন চলে, সে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেÑ এমন বলা যাবে না; যদিও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন অনেক দেশের জন্য মডেল।
গত শুক্রবার সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় একদিনে ৭টি বাল্যবিয়ের আয়োজন করা হয়। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে বাল্যবিয়েগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শুধু বাল্যবিয়ে বন্ধই করেননি, এর সাথে জড়িতদের দন্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাল্যবিয়ে রোধে তাঁর এই কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই। তাছাড়া যারা এসব বিয়ের তথ্য দিয়ে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁদেরকেও জানাই কৃতজ্ঞতা।
আমরা মনে করি, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা ও সার্বিকভাবে সামাজিকসহ অন্যান্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বিঘিœত হবে, যদি বাল্যবিয়ে রোধ করা না যায়। কেননা এতে শুধু মাতৃমৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাই ঘটছে, তা নয়। বরং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান, পুষ্টিহীনতা, সাংসারিক মানসিকতার অপরিপক্বতাসহ নানাবিধ জটিলতা তৈরি হয়। ফলে সমস্যার ভয়াবহতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাল্যবিয়ের কারণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক সমস্যা, বিভিন্ন কুসংস্কারসহ অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের বোঝা মনে করে বিয়ে দিতে উদ্যত হন। এতে পরবর্তী সময়ে বাল্যবিয়ের কারণে নেমে আসে বিপর্যয়, যার নেতিবাচক প্রভাবে শুধু ভুক্তভোগী নয়, বরং তা পরিণত হয় জাতীয় সমস্যায়।
জানাগেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ৩৭ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বাল্যবিয়ে রোধে জাতীয়ভিত্তিক প্রচার বা সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট তৎপর হতে হবে। বাল্যবিয়ে রোধে আইন যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই এ প্রবণতা কমে আসবে।
বাল্যবিয়ে রোধ না করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হবে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, দেশের কোনো উন্নয়নের ফলই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না, যদি বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক সমস্যা রোধ করা না যায়।
সুনামগঞ্জ সদরে একদিনে সাত বাল্যবিয়ে বন্ধের খবরটি আমাদের মধ্যে আশা জাগায়। প্রশাসনের এমন তৎপরতাই সবার কাম্য। মনে রাখতে হবে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে শুধু প্রশাসন নয়, সর্বসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলেই বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক সমস্যা রোধ করা যাবে।