পিযুষ চক্রবর্তী ::
হাওর অধ্যুষিত ভাটির জনপদ নিয়ে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জ। মাছ, পাথর, বালি আর ধানকে বলা হয় সুনামগঞ্জের প্রাণ। সম্পদের প্রাচুর্য থাকার পরও শিক্ষা যোগাযোগ মৎস্য, ধান এর উৎপাদন কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্র তৈরি ও সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগের অভাব রয়েছে। যার কারণে স¤পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কর্মকান্ড পশ্চাৎপদভাবে রয়ে গেছে। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য শিক্ষা, যোগাযোগ উন্নয়নে নিয়মিত বরাদ্দের বাইরে গিয়ে বিশেষ বরাদ্দ দিলে অবস্থার উন্নতি ও আশার সঞ্চার ঘটবে। স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর, শিল্প কারখানা স্থাপন, বালু থেকে কাঁচ ফ্যাক্টরি, চাল উৎপাদনের আধুনিক মিল, মুড়ি ও চিড়ার মিল, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে প্রকৃতির আপন মহিমায় মহিমান্নিত এই সুনামগঞ্জ জেলায়। এ জেলায় আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলে ও এর সদ্ব্যবহার করলে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে এবং দেশের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করবে। দেশের বৃহৎ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লাফার্জ সুরমা সিমেন্টের অবস্থান জেলার ছাতক থানায়। ছাতকের মত সুনামগঞ্জ জেলার অন্যান্য থানা/উপজেলায় দেশের শিল্পপতিগণ এগিয়ে আসলে এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে শিল্প উন্নয়ন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জকে আরো সমৃদ্ধির পথে প্রশারান্তর করা সম্ভব। সুনামগঞ্জ ধান ও মাছের জন্য বিখ্যাত। এখানে স্থানীয় পর্যায়ে চাল তৈরির জন্য আধুনিক মিল থাকা প্রয়োজন। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের দেশী মাছের চাহিদা স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে। এখানের হাওরগুলোতে উন্নত প্রযুক্তিতে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ কৃষক বোরো মৌসুমে এক ফসলের উপর নির্ভরশীল এবং তা দিয়েই খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই একটি মাত্র বোরো ফসলকে আগাম বন্যা ও পাহাড়িঢল থেকে রক্ষা করতে আজও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থতার ঘানি টানছেন। বোরো ফসল রক্ষায় প্রতি বছর যে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে সেগুলোকে কী ভাবে স্থায়ী করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। বোরো ফসল রক্ষায় এবং যথাযথ ব্যবস্থায় ফসলের উন্নয়ন প্রথম অগ্রাধিকার। কারণ এক ফসলের সঙ্গে জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ৮০ভাগের উপরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। হাওর, নদী-নালা ও পালতোলা নৌকার ঐতিহ্যবাহী ভাটির দেশ বাংলাদেশ। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলা নদী ও হাওর অধ্যুষিত অন্যতম জেলা। অথচ নদী-নালা, হাওর প্রতি বছর উজানি ও পাহাড়িঢল এসে ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পুনঃখনন করলে এবং প্রাকৃতিক উপায়ের মাছ সংরক্ষণ করলে বৃদ্ধি পাবে এবং সাথে সাথে খাদ্য প্রাণ মাছের আমদানি সহ পানি সরাসরি ফসল রক্ষা বাঁধে আঘাত করবে না এবং ফসল পানিতে তলানির আশঙ্কা কমে যাবে। এ জেলায় বিপুল পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বোরো জমিতে আগাম জাতের ফসল চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশি জাতের মাছ উৎপাদনে সুনামগঞ্জের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মৎস্য নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করার কারণে দেশি জাতের মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে। নদীতে বাঁধ দিয়ে ও বিল শুকিয়ে মাছ শিকারের ঘটনা বেড়েই চলছে। মাছের অভয়ারণ্য এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় সময়োপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অন্যান্য অভয়ারণ্যগুলো চিহ্নিত করে সুরক্ষিত রাখতে হবে। হাওর প্রধান জেলা সুনামগঞ্জ যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মূল জেলা সদরের সাথে ১১টি উপজেলার অধিকাংশই সড়ক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন এতে জেলার সামাজিক ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতির উপর এবং জীবনমান মানবেতর পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। যে উপজেলাগুলোর সাথে সড়ক যোগাযোগ যুক্ত রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও বেহাল। জেলার সার্বিকদিক উন্নত করতে হলে হাওরের প্রতিকূলতা দূরীভূত ও সুরক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। শুকনো মৌসুমে নৌ যোগাযোগ যখন ব্যাহত হয় তখন সার্বিক ব্যবস্থার উপর কষ্টসাধ্য ও নেতিবাচক প্রভাব পরে। জলপথে যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে নদী খনন জরুরি। দেশের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ রাখার একমাত্র পথ সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ও বাস যোগাযোগ যা আজও মহাসড়কে রূপান্তরিত বা উন্নীত হয়নি। এতে যাতায়াত অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে জেলা সদর তথা থানা/উপজেলা সদরগুলির জনজীবনে। তবে মানুষের মাঝে কিছুটা আশার সঞ্চার ঘটেছে “আব্দুজ জহুর সেতু” এখানকার জনজীবন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ যাতে উন্নত হয়ে জেলা সদরের সঙ্গে সহজে উন্নত যোগাযোগ করা যায় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে এবং বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী দিনের খাদ্যভান্ডার হাওর, আর এই হাওর অঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জে কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এতে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতির পথকে ত্বরান্বিত করবে।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুনামগঞ্জের এই হাওর অঞ্চল। কিন্তু এ অঞ্চল নিয়ে তেমন কোন কাজ হয়নি, যদিও হাওর এলাকা নিয়ে কাজের সুযোগ রয়েছে অনেক। হাওর অঞ্চলে স্থায়ী কোন কাজের ব্যবস্থা নেই। বছরের ৪/৫ মাস কাজ থাকে বাকি সময়টা অলস কাটাতে হয় বেশিরভাগ মানুষকে। ফলে যুব সমাজ দিন দিন বিপথগামী হচ্ছে। অফুরন্ত সম্ভাবনার হাওরকে আমরা সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এখানকার কৃষি ও মৎস্য সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মৎস্য ও কৃষি চাঙা হলে শুধুমাত্র কৃষক নয় উপকৃত হবে স্থানীয় জাতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। হাওর অঞ্চলের পতিত জমিতে কোথাও ২/৩টি ফসল আবাদের জন্য শস্যজাত নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জলজ, কৃষি বা উন্মুক্ত এবং বদ্ধ জলাশয়ে করতে হবে মাছ চাষ। কৃষককে সমান্তরালের সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী ও বহুস্তরে সাজাতে হবে। বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উঁচু ভিটা তৈরি কাটা ধান আনা নেওয়ার জন্য হালকা কিন্তু টেকসই পরিবহন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। দাদনের ছোবল থেকে কৃষককে রক্ষায় “হাওর উন্নয়ন ব্যাংক” করা যেতে পারে। হাওর অঞ্চলে “বীজ উৎপাদন এবং প্রক্রিয়া জাতকরণ” কৃষি ও মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছে। কৃষি কর্মীদের জন্য দরকার স্থায়ী অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও হাওর ভাতা চালু করা। হাওর কৃষিকে মানুষের রোজগার আর কর্মক্ষেত্র সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বারে রূপান্তরে ব্যাপক উদ্যোগ, প্রকল্প, বাজেট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তা হবে আমাদের দুর্দিনে খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। নিরাপত্তার উৎসভূমি হবে সুনামগঞ্জ তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাওর অঞ্চল।
[লেখক : কলামিস্ট, প্রাক্তন শিক্ষক]