‘জিনের বাদশাহ পরিচয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকার প্রতারণা’। চমৎকার সে চমৎকার! শুনতে সত্যি চমৎকার লাগতে পারে কারও কারও কাছে এবং এই চমৎকার লাগার জন্য কেউ যদি একচুট হেসেও নেন, তা বোধ করি মন্দ হবে না। বলিহারি মানুষের বুদ্ধির বহর ও বাহার। সকলেই জানেন, মানুষ বুদ্ধিমান জীব। মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হমোসফিয়ানস। বঙ্গীকরণে দাঁড়ায় বুদ্ধিমান মর্কট। কিন্তু মানবপ্রজাতি জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে এতো বেশি উন্নতিগ্রস্ত হয়েছে যে, সে যে একধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী সেটা ভুলে গিয়ে অ্যাটম ও হাউড্রোজেন বোমা বানাতে শুরু করেছে এবং তারই মতো অন্যান্যদেরকে ভয় দেখিয়ে স্বার্থ আদায়ে নিমগ্ন হয়ে ভীষণ ভীষণ আনন্দে দিনাতিপাত করছে। আর আমাদের জগন্নাথপুরে একজন জিনের বাদশা সেজে আরেকজনের সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন গ্যাড়াকলে পড়েছেন। একেই বলে বুদ্ধির বহর-বাহার। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় বুদ্ধির বহর-বাহারকে অতিক্রম করে এখানে স্বার্থবুদ্ধিই প্রাধান্য লাভ করেছে। স্বার্থবুদ্ধি মানে নগদ নারায়ণের পূজাপার্বণে নিমগ্ন থাকার বুদ্ধি, যাকে লোকে বলে সাংসারিক বুদ্ধি এবং প্রতিবেদকের বর্ণনায় ‘টাকার লোভ’।
এই টাকার লোভ এতোটাই সর্বনাশা যে, বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে লোকে অ্যাটম বা হাইড্রোজেন বোমা বানিয়ে তা ফাটিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিসরে সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিতকরণে বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠা-াযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। আর জগন্নাথপুরে একজন আর একজনকে ঠকিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে। দু’টি বহরে ও বাহারে ভীষণ পৃথক। একটি বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ও রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে শোষণ নিশ্চিতকরণের উপায় পাকাপোক্তকরণ, অন্যটি ¯্রফে মানুষের সীমাহীন লোভের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ব্যক্তি কর্তৃক ব্যক্তিকে প্রতারিত করে সম্পদ আহরণের অবিমৃষ্যকর প্রতিযেগিতার নির্দেশক। দু’টিরই লক্ষ্য এক, সে-লক্ষ্যটা অর্থের প্রাচুর্য অর্জনের প্রতিযোগিতা। কিন্তু জিনের বাদশাহকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় মানুষের বুদ্ধির বিকাশের পরাকাষ্ঠার কোনও প্রকাশ নেই, নেই যে তার সমর্থন মেলে অন্তত প্রতারিতপক্ষের আচরণকে বিবেচনায় নিলে।
এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের উচিত অন্তত, নাগরিকদেরকে এমন বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবত অবস্থা অনুধাবনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, যাতে অন্তত তথ্যপ্রযুক্তির প্রভুত উন্নতির যুগে জিনের বাদশাহর তরফ থেকে টাকা প্রাপ্তির অবাস্তব ধারণা পোষণ থেকে লোকে বিরত থাকে। ভুলে গেলে চলবে না যে, এই ঘটনাটি দেশের মানুষের বিজ্ঞান মনস্কতার অভাবের পরিচায়ক। জিনের বাদশাহতে বিশ্বাস স্থাপন করে কেউ কী করে ২০১৯ সালের পৃথিবীতে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকের মর্যাদা পেয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকার মালিক বনে যায়, সেটা কেমন জানি বোধাতীত ঠেকে।