মহাকালের নিরিখে অতিসম্প্রতি, অর্থাৎ বিগত কয়েক বৎসর যাবৎ, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি জেলায় অস্বাভাবিক মাত্রায় বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটছে। উপদ্রুত এলাকা ফসলহানিসহ বসতভিটা, সড়ক ইত্যাদি অবকাঠামোগত দিক থেকে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিবছর, যার অর্থমূল্য পরিমাপ করা যৎপরনাস্থি দুষ্কর এবং বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ ও পানিবাহিত রোগ সংক্রমণের কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে অধিবাসীরা। তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে সে সম্পর্কেও একেবারে উদাসীন থাকা বোধ করি সমীচীন হবে না।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, এই কদিন আগের পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ১২০ কিলোমিটার পাকা সড়ক বিনষ্ট হয়েছে। ২০০৭ সালে সীমান্তের অপারের ভারতীয় পাহাড় ধ্বসে তাহিরপুর সীমান্তের চানপুর এলাকার প্রায় ৩০০ একর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। ইতোমধ্যে সে এলাকারই পচাশোল নামের একটি হাওর বালুভরাট হয়ে নিষ্ফলা উষর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। হাওরের উদ্ভিদবেচিত্র্য গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেছেন যে, পাহাড়ি ঢলে ভারত থেকে নেমে আসা বালু বহু আগেই বাংলাদেশের নদী, হাওর ইত্যাদি ভরাট করে ফেলেছে। এবংবিধ আলামত অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামক দেশটির মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। মরুভবনের হুমকিতে পড়া ছাড়াও আশুকর্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে যদি প্রতি বছর এই রকম সড়কসহ ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি নির্মাণ-মেরামত করার আর্থনীতিক চাপের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয় তবে সে বাড়তি আর্থনীতিক ব্যয়ভারের দুর্ভোগটাও অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হরে বৈ কি। বিষয়টা তখন বাংলাদেশের পক্ষে কেমন বা কী ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়, দেশের নীতিনির্ধারকদেরকে একবার কল্পনা করে দেখতে বলি।
অভিজ্ঞজনেরা বলেছেন যে, উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট স্থানের পাহাড়, গাছ ইত্যাদি কেটে সড়ক, ঘরবাড়ি ইত্যাদি আধুনিক স্থাপনা তৈরি করা অব্যাহত আছে। এই পাহাড় ও গাছ কাটার কারণে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ে যে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে প্রক্ষিপ্ত হয় এবং অনাদি কাল থেকে তা-ই হয়ে আসছে। সে পানি নিচে, অর্থাৎ বাংলাদেশের সমতলে, নামার সময় এখন আর কোনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না, দ্রুত নেমে আসে ঢলের আকার নিয়ে এবং আনিবার্যভাবে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোকে প্লাবিত করে বন্যা দুর্গত করে ফেলে। এইভাবে জল নিচে নামার সময়, অতীতের মতো গাছপালার প্রতিবন্ধকতা বা প্রাকৃতিক ছাকনির অনুপস্থিতির দরুণ, মরুভবন সম্ভব করে তুলার উপকরণ বিপুল পরিমাণ বালু প্রতি বছর নিয়মিত নির্বিঘেœ নিচে নেমে এসে বাংলাদেশকে মরুভবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে সেটা টের পাওয়া যাবে যখন আর প্রতিকারের কোনও উপায় থাকবে না। মনে রাখতে হবে, আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকাল আগে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে যে অভিবাসন প্রক্রিয়া পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছিল, সেটা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বন উজাড় করে দিয়েছে। দেশের উত্তরে মরুভবন রোধে কার্যকর যে পরিমাণ ঘন জঙ্গল ছিল, যা বাংলাদেশকে উত্তরের পাহাড় থেকে নেমে আসা বালুতে সমতলের ভূমিভরাটের বিপদ থেকে রক্ষা করতো, সে বন এখন আর নেই। বন নেই সেহেতু বনজঙ্গলের সে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচও এখন আর নেই। এইভাবে স্বদেশের জন্য অনিবার্য মরুভবনের বিপদকে আহ্বানের সুবর্ণ সুযোগ ইতোমধ্যেই সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে এবং ইদানিং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে দেশের পাহাড় কাটা ও বনউজাড়নের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার অনিবার্য প্রভাব যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পরিবেশগত পরিস্থিতিকে আরও অধিক পরিমাণে বিপজ্জনক করে তুলেছে। এর সরার্থ হলো প্রতিবছর নিয়মিত বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের অনিবার্য ক্ষতি সংঘটনের অত্যাচার বাংলাদেশকে সহ্য করতেই হবে, অদূর ভবিষ্যতে মরুভবনের আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়েই, যদি ভারতের উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন কর্মের স্বার্থে পাহাড় কাটা ও বনউজাড়ন প্রক্রিয়া বন্ধ না হয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে মিলে স্বদেশে সৃষ্ট বন্যা, পাহাড়ি ঢল, বালুভরাট, মরুভবন, নদীতে অনাব্যতা ইত্যাদির মতো সকল প্রাকৃতিক সমস্যার সমাধানের পথ অনুসন্ধান করতে অতিসত্বর অতিঅবশ্যই উদ্যোগী হতে হবে।