গত ২১ এপ্রিল দৈনিক সুনামকণ্ঠে একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতি ছাত্রাবাস ॥ বেহাল ছাত্রাবাসে নানা অব্যবস্থাপনা’। সমস্যা থাকতেই পারে। মানুষ ও মানুষের জীবন সমস্যাকে সঙ্গে নিয়েই চলে। এটাই জীবনের দস্তুর। একটি ছাত্রাবাসের ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হতে পারে না। সেটি বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। এর অবকাঠামো জীর্ণ হয়ে পড়তে পারে। মেরামতের কিংবা পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের হিন্দু হোস্টেলটির (বর্তমান নাম কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতি ছাত্রাবাস) অবস্থা এমন হয়ে পড়েছে যে, এটিকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অন্তত প্রতিবেদনের বর্ণনা থেকে যে-কারও মনে হতেই পারে যে, এটিকে মেরামত নয় নতুন করে নির্মাণের আবশ্যকতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদক যথারীতি ছাত্রাবাসের ভৌত অবকাঠামোর বেহাল অবস্থার বর্ণনা করেছেন এবং তার পাশাপাশি ছাত্রাবাসটির আভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার বর্ণনাও তোলে ধরেছেন। পাঠ করার পর কেন জানি মনে হয়, এই ছাত্রাবাসে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়। একটু অদ্ভুত বিস্ময়ের স্পর্শ লাগে মনে এবং সহসাই মনে পড়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি ছত্রছায়ায় একধরনের রাজনীতিক পৃষ্ঠপোষকতার জোরে ছাত্র কিংবা অছাত্রের দৌরাত্ম্যের সর্বজনবিদিত ও আলোচিত প্রসঙ্গের যাবতীয় অনুষঙ্গকথা। তা আমাদের সুনামগঞ্জের সরকারি কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাসটি কেনইবা প্রচলিত এই প্রথাপ্রকরণের ব্যতিক্রম হতে যাবে? এখানেও যা হবার তাই হয়েছে। প্রতিবেদক বলেছেন, ‘অছাত্র হয়েও তিনি হোস্টেলের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। …তার কথা অনুসারে সাধারণ ছাত্রদের থাকা না থাকা, চলাফেরা, খাবার-দাবার, রাজনীতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কেউ প্রতিবাদ করলে … তাকে হারাতে হয় হোস্টেলের সিট। মিঠু সাধারণ ছাত্রদের তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। … মিঠুকে কেন্দ্র করে চলে হোস্টেলে অছাত্রদের আনাগোনা। ফলে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়। মিঠুর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই।’
মিঠু কে সেটি কোনও বড় কথা নয়। আমাদের প্রশ্ন হলো সরকারি এই ছাত্রাবাসটি পরিচালনা বা দেখভাল করার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষীয় কোনও তত্ত্বাবধায়ক কি নিয়োজিত নেই? যদি থাকেন তবে তিনি কী করেন? তিনি কি তাঁর দায়িত্ব এই তথাকথিত মিঠুর ঘাড়ে অর্পণ করে নিজে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকেন এবং কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ মহোদয় যৎপরনাস্তি নিশ্চিন্ত থাকেন, যখন তাঁর প্রিয় ছাত্ররা একজন অছাত্রের দ্বারা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত উপায়ে দিনের পর দিন উৎপীড়িত হয় এবং অছাত্রটি ছাত্রের অধিকার ও সুযোগ কেবল গ্রহণই করেন না, তিনি যে ছাত্র নন তার প্রমাণ হিসেবে প্রতিনিয়ত ছাত্রদের উপর অন্যায় অধিনায়কত্ব ফলান এবং ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করেন। বাঁকা প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই ব্যক্তিগত ব্যবহারের অর্থ কী? একটি রাষ্ট্রের ভেতরে একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠিত থাকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত শিক্ষানীতি অনুসারে একটি সরকারি ছাত্রাবাসে একজন অছাত্রের এই ব্যক্তিগত অধিকার ফলানোর কোনও আইনগত ভিত্তি আছে কি? যদি না থাকে, তবে কীভাবে এবং কোন আইনি অধিকারের বলে কিংবা কার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এই অছাত্র ছাত্রাবাসে বাস করার অধিকার পেলেন? কলেজ কর্তৃপক্ষ এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? এমতাবস্থায় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, এই অছাত্র মিঠুর কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতি ছাত্রাবাসে অবস্থান করা, ছাত্রদের উপর খবরদারি ফলানো ও ছাত্রদেরকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না?
পরিশেষে বলি, সুনামগঞ্জের অনেক রাজনীতিক সংগ্রাম-আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত এই হিন্দু হোস্টেলটি সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিপূর্ণ সংস্কার চাই। জানা কথা, কোনও না কোনও দিন এটিকে ভেঙে ফেলা হতে পারে। কিন্তু তার আগে অর্থাৎ নতুন করে বিনির্মাণের আগে এই প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি যেন উপেক্ষা করা না হয়।