পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে এমন করে গঠন করা হয়েছিল যে, তখন সমাজটা এক ধরনের পশ্চাৎমুখি না হয়ে কোনও উপায় ছিল না। ১৯৪৭-য়ের ১৪ আগস্টের পরের দিন ১৫ আগস্ট থেকেই পূর্ববাংলা স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বাস্তবে বঞ্চিত হতে থাকে। অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চালে সাতচল্লিশের স্বাধীনতার সূর্যটা উদয় হয়েই প্রকারান্তরে অস্তগামী হয়ে পড়ে। পূর্ববাংলা কার্যত পাকিস্তানের অধিকৃত একটি উপনিবেশে পর্যবশিত হয়। মোটকথা তৎকালে পাকিস্তানের পূর্বাংশ পূর্বপাকিস্তান কার্যত অন্ধকারেই আচ্ছন্ন ছিল। ১৯৭১-য়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে না করতেই, অর্থাৎ বছর তিনেক যেতে না যেতেই ঘাপটি মেরে থাকা ৭১-য়ের পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে এবং মুক্ত দেশের গতিকে পশ্চাতমুখি করে দেয়। প্রতীকী অর্থে আমরা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা, আলোর পৃথিবী থেকে আবার অন্ধকারের পৃথিবীতে বন্দি হয়ে পড়ি। ১৯৪৭-য়ের স্বাধীনতা থেকে ১৯৭১-য়ের স্বাধীনতা এবং ১৯৭৫ আবার পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতা দখল, সর্বসাকুল্যে একবিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসকে এককথায় বর্ণনা করা যায়, সমাজের প্রগতির চাকাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার রাজনীতিক সাফল্য হিসেবে। সমাজোন্নয়নের এই চাকাটিকে প্রগতির দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেটা হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থেকে। তবু স্বস্তির বিষয় যে, হচ্ছে তো, আগে তো হতোই না। যে-কাজ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করার কথা ছিল ১৯৪৭-য়ের স্বাধীনতার পরেই, সে-গুলো এখন বিলম্বে হলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ঘোষণা হচ্ছে এবং আমরা গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠে পড়তে পাচ্ছি, ‘দালালমুক্ত করা হবে ভূমি অফিস’, কিংবা ‘আগামী মাসে আড়াই হাজার শিক্ষপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি’। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রকে আগে দেশের উন্নয়নের বিপক্ষে কাজে লাগানো হয়েছে এবং এখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের ঘোষণা করছেন। শেখ হাসিনার সরকার সুস্পষ্টভাবে এইটুকু পরিবর্তনকে রাজনীতিক কাজের কর্তব্য হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছেন।
আমরা কেবল আশা করবো, এইসব সুন্দর সুন্দর স্বপ্নসাধ প্রতিশ্রুতির রাজনৈতিক চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে না এবং রাজনীতির এই পরিবর্তনটুকুই আপাতত সাধারণ মানুষের পথচলার পাথেয় হয়ে উঠবে এবং এই পরিবর্তনটা মুখোশ পরা রাজনীতিকে নির্মূল ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতাকে প্রতিহত করবে।