হাওরে বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সুনামগঞ্জ সদর ও ধর্মপাশায় বজ্রপাতে ২ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছেন। একজনের মৃত্যুর বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘স্থানীয়রা জানান, ওইদিন বিকেলে কৃষক আব্দুল আওয়াল তার বেগুন ক্ষেতে কাজ করছিলেন। এসময় আকস্মিক বজ্রাঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্বজনরা তাকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।’
এমন ঘটনা অতীত দিনে যে ঘটত না এমন নয়। অতীতেও আমাদের দেশে বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তবে তা কালেভদ্রে, এত ঘন ঘন ও সংখ্যায় এত বেশি নয়। অতিসাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের তুলনায় অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
সকলেই জানেন যে, অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রভাব বেশি করে কার্যকর হয়েছে, যে জন্য বজ্রপাতের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। বজ্রপাত অধিক হলেই বজ্রাঘাতে মানুষ মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাবে এমন কোনও কথা নয়। কথা হলে ঊর্ধ্বাকাশের সঞ্চিত মেঘবহরে উৎপন্ন বিদ্যুৎ পৃথিবীতে পতিত হওয়ার সময় বৃক্ষহীন খোলা মাঠে মানুষকে অবলম্বন করে মাটিতে নিঃশেষিত হয় এবং বিদ্যুৎস্পর্শে মানুষ মারা যায়। অতীতে হাওরের আনচে কানাচে মাঠে ময়দানে বনজঙ্গলে উঁচু বৃক্ষ ছিল, এমকি ক্ষেতের ধারে কিংবা আল পথে গাছগাছালির অভাব ছিল না। জনসংখ্যাস্ফীতি ও বনউজাড়ন অব্যহত থাকায় বর্তমানে ক্ষেতের ধারে কাছে কিংবা খোলা মাঠে কোনও গাছ নেই বললেই চলো। এমতাবস্থায় বিদ্যুৎ আকাশের মেঘখ- হতে লাফিয়ে মাঠের খোলা স্থানে উপস্থিত মানুষকে অবলম্বন করে মাটিতে নিপতিত হয়। এই কারণে বর্তমানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় ব্যাপকাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এর প্রতিকার কী? জবাব খুবই সহজ কিন্তু কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন। এ অবস্থায় বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর জনসচেতনতার জন্য কিছু নির্দেশনা জারি করে। এগুলো হল- ১. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি ¯পর্শ করবেন না। ২. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দ- স্থাপন নিশ্চিত করুন। ৩. খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান। ৪. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান। ৫. খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে। ৬. ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। ৭. ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। ৮. বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে। ৯. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়। এই সময়ে আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করুন। ১০. যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কনক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। ১১. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকবেন না এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন। ১২. ঘন-কালো মেঘ দেখা গেলে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারেন। ১৩. উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন। ১৪. বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন। ১৫. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকবেন না। ১৬. কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকুন। ১৭. বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন। ১৮. বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়–ন। ১৯. বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির থাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না। সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কনক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। ২০. বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে আমাদের এসব নির্দেশনাগুলো মানতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের কোনও বিকল্প নেই।