২৬ মার্চ দেশে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়ে গেল। জানি নামিদামি, গণ্যমান্য অনেকেই বক্তৃতা করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। নিয়মমাফিক বড় বড় কথা, আশা ও প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত স্বপ্নসাধ, আকাশবাতাস প্রকম্পিত করেছে। বরাবরের মতো প্রতি বছর দেশের প্রতিটি পত্রিকা যেমন সংবাদ পরিবেশন করে লিখে থাকে তেমনি দৈনিক সুনামকণ্ঠে লেখা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার ৪৮তম বার্ষিকীতে বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশ-মাতৃকার বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করলো সুনামগঞ্জবাসী।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যে ‘বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়া’-র কথা বলা হলো, আমাদের দেশের বা রাষ্ট্রকর্তৃক অনুসৃত অর্থনীতির নীতি কী সে- ‘বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়া’-র পক্ষে কোনও ভূমিকা রাখছে? এই প্রশ্নের উত্তরে কোনও ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করা আপাতত কোনও অর্থনীতিবিদের পক্ষেও সম্ভব নয়। সহজ কথায় বললে বলতেই হয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতির নীতি মোতাবেক ধনীদের আরও ধনী হওয়ার অর্থনীতি এখানে চালু আছে। এই কথার মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই মিথ্যাচারিতার কোনও স্পর্শ নেই। আর যে-কোনও অর্থনীতিবিদই জানেন যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি চলে মুনাফার উপর ভর করে। আর যেখানে মুনাফা থাকে সেখানে মুনাফার অবিচ্ছেদ্য পরিণতি শোষণ থাকবেই। উদ্বৃত্তশ্রম শোষণ না করে পুঁজিবাদ বাঁচতে পারে না। অর্থনীতির সর্বজনবিদিত এই নীতি অনুসারে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, সে-উন্নতি ধনীদের উন্নতি, গরিবের নয় কিংবা দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থনীতি নয়। দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থনীতি মানেই ‘বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত অর্থনীতি’।
এর বেশি কীছু আপাতত বলতে চাই না। প্রতি বছর জাতীয় দিবস কিংবা এমনবিধ দিবসগুলোতে আমাদের সমাজ নিয়ন্ত্রকরা এইরকম প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং বক্তৃতার মঞ্চ থেকে নেমে সে-প্রত্যয়ের কথা ভুলে যান এবং সাধারণ মানুষও ভুলে যায়, এইভাবে প্রতিশ্রুতির চোরাবালিতে ডুবে যাবার প্রবণতাকে রোধ করতে হবে।
পাকিস্তান আমলের কথা বলতে গিয়ে গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘আমাদের পাট-চা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অর্থকরী ফসল বিদেশে রফতানি করে সব অর্থ নিয়ে যেতো পাকিস্তানিরা।’ তেমনি এখন আমাদের ‘সব অর্থ’ নিয়ে যাচ্ছে ধনীরা। সুতরাং জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে বক্তৃতার মাধ্যমে ‘বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেশবাসীকে দেখানোর আগে শোষণমুক্ত অর্থনীতি বা সম্পদের সমবণ্টন নীতির কার্যকর প্রচলন করতে হবে এবং কার্যত দুর্নীতিও নির্মূল হবে। অন্যথায় পাকিস্তানিরা যেমন পূর্বপাকিস্তানি তথা বাংলাদেশিদের শোষণ করতো তেমনি বাংলাদেশের ধনীরা গরিবদের শোষণ করতেই থাকবে এবং প্রকারান্তরে বাংলাদেশ কতিপয় ধনীর দেশে পরিণত হলেও হতে পারে কিন্তু ‘বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ’ কোনও দিনই হয়ে উঠবে না।