অন্ধের হস্তী দর্শন বলে একটা গল্পকথা আমাদের দেশের লোকসমাজে প্রচলিত আছে। বোধ করি গল্পটা সবারই জানা। সেটা ফলাও করে বলবার অবকাশ এখানে সম্পাদকীয়তে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত এই ‘অন্ধের হস্তী দর্শন’-এর ঘটনা ঘটেই চলেছে। একটা নির্দিষ্ট বস্তু, বিষয়, প্রপঞ্চ কিংবা সমাজবাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করার বিষয়ে মূর্তনির্দিষ্ট সত্যকে আবিষ্কার করা যাচ্ছে না বা যাঁরা প্রত্যক্ষ করছেন তাঁদের প্রত্যক্ষণ বিষয়টি অন্ধের হস্তী দর্শনের চেয়ে বেশি কীছু হচ্ছে না। আমাদের জাতীয়তা নিয়ে এই অন্ধের হস্তী দর্শনের খেলা চলেছে, বহুদিন ধরে। এই বঙ্গভূমির জনগোষ্ঠীকে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বাঙালি, কেউ আবার বাংলাদেশি রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন কিংবা করছেন, এমনকি এক শ্রেণির লোকেরা পাকস্তানি আমলে পাকিস্তানি রূপে দেখতে কসুর করেননি। বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে কোনও কীছু নিয়ে নির্বিচারে অন্ধের হস্তী দর্শনের খেলা শুরু হয়ে যায় এবং সেটাকে কৌশলে সাধারণ মানুষের চোখে ঠুলি পরানোর যাদুতে পরিণত করা হয় এবং মওকা বুঝে যে-যার কাম বাগিয়ে নেয় অর্থাৎ স্বার্থোদ্ধার করে পগারপার হয়ে পড়ে, কারও কীছু করার থাকে না। যাঁরা কীছু একটা করার কর্তৃপক্ষ তাঁরা একেবারে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নিশ্চুপ থাকেন, নির্বিকার থাকাই তাঁদের একমাত্র কর্তব্য, অন্যথায় নামকাওয়াস্তে একটা তদন্ত কমিটি হয়, যে-কমিটি কখনও প্রতিবেদন দাখিল করে না, আর যদিও করে তব সে-প্রতিবেদন অসূর্যমস্পর্শ্যা রমণীর মতো মহাফেজখানায় পড়ে থাকে, কখনও জনসমক্ষে মুখ দেখায় না।
হাওরাঞ্চলে ফসলরক্ষাবাঁধের কাজ চলছে। ২৮ ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ করার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। কতোটুকু কাজ হয়েছে সে হিসাব নিয়ে শুরু হয়েছে অন্ধের হস্তী দর্শনের গল্প। প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষদর্শী কৃষকরা বলছেন মাত্র ৫০ ভাগ কাজ হয়েছে। এদিকে স্বয়ং পানিউন্নয়ন বোর্ডের দাবি ৮৬ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। এখন কথা হলো সত্য একটা, সত্য একের অধিক হতে পারে না। আসলে কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কানার ভূমিকায় অভিনয় করছে? হাতিকে থাম, দেওয়াল, কূলা, দড়ি ইত্যাদি বানিয়ে ফেলছে। সত্যিকার অর্থেই সাধারণ মানুষ ভীষণ বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিপতিত হয়েছেন।
সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হোন, তাতে কীছু যায় আসে না। কিন্তু দেশের দ-মু-ের মালিক সরকার বাহাদুর কী ভাবছেন সেটাই বড় কথা। সরকার কাকে সত্য বলে মানবেন। পাউবোকে সত্য বলে ধরে নিলে রাষ্ট্রের মালিক দেশের মানুষকে মূর্খ প্রতিপন্ন করা হবে। আমরা ভুলে যাইনি, ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জকে দুর্গত ঘোষণার সঙ্গত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জবাসীকে প্রকারান্তরে মূর্খ বলে জনৈক সচিব পার পেয়ে গেছেন, সরকার তাঁর অভব্যতার কোনওরূপ প্রবিবিধানকল্পে যৎকিঞ্চিৎ প্রযতœ গ্রহণ তৎপরতা প্রদর্শন করেননি। এবার ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের হিসাব নিয়ে পাউবো’র পরিসংখ্যান প্রতারণারও কোনও প্রতিকার হবে না বলেই মনে হয়। আমরা কেবল এই প্রত্যশায় আছি যে, সরকারের সত্য উদ্ধারের প্রযতেœর ফাঁক গলে যেনো, ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে যারা নয় ছয় করেছেন তারা পগারপার না হয়ে যান। বাঁধের কাজ নিয়ে প্রতারণাকারীদের ছাড় দেওয়া কীছুতেই সঙ্গত নয়।