বাংলাদেশের মানুষ এক সময় স্বপ্ন দেখতো সামাজিক সাম্যতার। সংবিধানে পর্যন্ত সে-সাম্যতার কথা এখন পর্যন্ত স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে সাম্যতার পথে চলা স্বপ্নবাজ প্রতিটি মানুষকেই প্রতিহত করা হয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে, তিনি স্বপ্নবাজ ছিলেন বলেই। কিন্তু এখন এতোসব অবাক করা কথা প্রতিদিন শুনছি যে, মনে হচ্ছে কোনও রূপকথার দেশে এসে পড়েছি। এসে পড়েছি কোনও স্বপ্নের দেশে।
যে-মানুষ স্বপ্ন দেখে না বা দেখতে জানে না, সে-মানুষ মানুষ নয়, সে মানুষ নামের অবান্তর। মানুষের স্বপ্ন মানেই নতুন ভাবনা, নতুন করে বাঁচা ও বাড়া, নতুন করে বাড়ি বানানো। পুরো দেশটাকেই নতুন করে তোলা, যেখানে কেউ মানুষের স্বপ্ন দেখায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না, কেউ কারও মাথার উপর কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরাবে না, কেউ না খেয়ে থাকবে না, প্রতিটি মানুষের বাকস্বাধীনতা থাকবে। এই দেশে এমন স্বপ্নবাজ হয়ে ওঠার জন্যে বুকের পাটা চাই। এ দেশের তরুণদের সে-বুকের পাটা ছিল, তারা একদিন স্বপ্নবাজ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিদ্ধের আগে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে সে-স্বপ্নবাজদের আখড়া হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। তখন একদিকে সাম্যবাদী চিন্তায় প্রভাবিত এইসব তরুণের পেছনে গোয়েন্দারা ঘুরঘুর করতেন। তারও পরে ১৯৭৫-য়ের রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মদদে এইসব স্বপ্নবাজ তরুণদের স্বপ্ন দেখার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে দেওয়া হলো, মৌলবাদী জঙ্গিবাদের উর্বরক্ষেত্রে পরিণত করা হলো দেশকে। স্বাধীনোত্তর সুখি-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো, বাঙালি পাকিস্তানি হতে না পেরে হয়ে গেলো বাংলাদেশী, তা একেবারেই আক্ষরিক অর্থে যত মিথ্যাই হোক তবু, জিয়া হঠাৎ করেই হয়ে গেলেন স্বাধীনতার ঘোষক। স্বপ্নবাজরা লোকান্তরিত হলেন এবং রাজাকার হলো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আর সংসদ সদস্য।
কিন্তু সেইসব স্বপ্নবাজদের স্বপ্নের কথকতা আবার ফিরে আসছে, কীছুটা অন্যরূপে। এবার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উচ্চমহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে সেইসব স্বপ্নের কথা। গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠে বেশ ক’টা সংবাদ ছাপা হয়েছে, যে সংবাদগুলো দেশের মানুষকে আশার আলো বিকিরণ করে। আমরা সেগুলোকে প্রচলিত প্রথানুসারে রাজনীতিকের প্রতিশ্রুতির চোরাবালি ভাবতে চাই না। তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলো হোক, যেমন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিশ্রুতি ছিল, তেমনি খাঁটি এবং তাঁরা সে-গুলো যথাযথভাবে কার্যকর করতে সামর্থ্য অর্জন করুন, এই কামনা করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ক্ষমতা ভোগের নয়, জনসেবার’। অথচ বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে সমাজের সর্বত্র, এমনকি রাজনীতিক পরিসরে ক্ষমতার অপব্যবহারের চর্চা এতো বেশি হয়েছে যে, ততোদিনে দেশবাসী তাতে একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ভিটায় ঘর করে দেবে সরকার’ এবং একজন জেলাপ্রশাসক স্বাধীনতার দুই বছর কম অর্ধশতাব্দী পরে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অবকাশ পেয়েছেন। এমন হবে, কেউ কি কখনও স্বপ্নেও ভেবেছেন? জানি না। কিন্তু স্বপ্নবাজদের উত্তরসূরিরা ফিরে এসেছেন এমনটা ভাবতে খুব ইচ্ছে করছে, তা হোক দুইবছর কম অর্ধশতাব্দী পরে। আর সেই সঙ্গে ভাবনা জুড়ে কেবল জেগে থাকে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হোকএই স্বপ্ন, এই প্রত্যাশা।