আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। পৃথিবীতে এমন উদাহরণ আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হওয়ায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি আমরা। ভাষা আন্দোলন শোক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বিগত শতকের চল্লিশের দশকে ভাষাবিতর্ক শুরু হয়ে যায়। তখনকার কিছু মুসলিম লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবী বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেয়, এ প্রসঙ্গে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন এবং খ্যাতনামা বাঙালি প-িত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বিতর্ক উল্লেখযোগ্য।
ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৭ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দন মজলিস’ এর উদ্যোগে সর্বপ্রথম গঠিত হয় “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। পরে গঠিত হয় “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ‘উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা’র প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিলের ওপর পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। এই শহীদদের রক্তের সিঁড়ি বেয়েই পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। আর এই আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে সত্য কিন্তু তা আজো আমাদের দেশের সকল স্তরে সেভাবে চালু হয়নি। আমাদের মাঝে ভিন দেশি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি, হিন্দি প্রীতিই বলে দেয় বাংলা ভাষা ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোকান, শপিংমল, ব্যানার, ফেস্টুনে ইংরেজি ভাষা, শব্দ, বাক্য ব্যবহারেই অভ্যস্ত। আর বিদেশি চ্যানেলগুলো এবং এফএম রেডিও আমাদের প্রজন্মকে বাংলা ভাষায় কথা বলাটাই যেন ভুলিয়ে দিতে চাইছে।
ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে তা আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই বলে নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। আগে আমাদের মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ ও সঠিকভাবে জানতে হবে। বাংলা ভাষার ওপর গবেষণা, চর্চা বাড়াতে হবে। আদালতসহ দেশের সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা চালুর উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। সমুন্নত রাখতে হবে বাংলা ভাষার মর্যাদা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারী বীর শহীদদের প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।