মহান মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলার অবদান কোনও অংশেই কম নয়। একাত্তরের যুদ্ধের সময় এখানেও মুক্তিকামী মানুষেরা পাক হানাদার, রাজাকার, আলবদরদের হাতে গণহারে প্রাণ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছেন। তার মধ্যে সুনামগঞ্জের কতোজন তার কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনও পর্যন্ত করে ওঠা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের পরিসংখ্যান তৈরি করার আগেই, বিধ্বস্ত দেশকে এই একটুখানি পুনর্গঠিত করার আগেই, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। সে ক্ষমতা তারা ধরে রাখতে সক্ষম হয় সুদীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। স্বাধীনোত্তর কালে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের পরিসংখ্যান কিংবা তালিকা তৈরি দূরে থাক দেশকেই পুনর্গঠনের অবকাশ মিললো না এবং প্রকারান্তরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট বড় বধ্যভূমিগুলো বছরের পর বছর জুড়ে পড়ে রইল অরক্ষিত অবস্থায় এবং ক্রমে নিশ্চিহ্নকরণের চক্রান্তের শিকার হয়ে একেবারেই অবলুপ্ত হলো, সুনামগঞ্জের পিটিআই এলাকার বধ্যভূমির মতো। বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ করার কোনও নীতি ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো গ্রহণ করেনি বরং তৎকলের ক্ষমতাসীনরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘরানার ছিল বিধায় তারা স্বাভাবিকভাবেই বধ্যভূমিগুলোকে অবলুপ্ত করে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে। সে-নীতির সার্থক পরিণতি হলো পিটিআই স্কুলের বধ্যভূমিটির স্থানে পরিকল্পিত উপায়ে সরকারি স্থাপনা তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন। এই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আসলে বধ্যভূমিগুলোকে অবলুপ্ত করে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে অবলুপ্ত করার ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল। অর্থাৎ যাকে বলে, পরিকল্পিত উপায়ে বধ্যভূমিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার রাজনীতি, জাতিকে তার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি, প্রকারান্তরে জাতির সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করা।
গত মঙ্গলবার (১৫ জানয়ারি ২০১৯) দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদপ্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের আওতায় সুনামগঞ্জ শহরের পিটিআই এলাকার বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিসৗধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরের দাবি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রকৃত স্থানটি বাদ দিয়ে তার পাশে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের চেষ্টা করছেন।’ এই প্রচেষ্টা কিংবা বধ্যভূমির স্থানের উপর স্থাপনা নির্মাণ প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবলুপ্তকরণের অপরাধের নামান্তর, এবং সেই সঙ্গে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা। ইতিহাস বদলে দিয়ে সচেতন কোনও মানুষেরই কাছেই এমন অবিমৃষ্যকর কা-কারখানা প্রত্যাশিত হতে পারে না।