একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “যখন একজন ব্যক্তি সরকারের কোনো শীর্ষ পদে যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তখন ওই দুর্নীতি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি করে।” এই পর্যবেক্ষণটি হাই কোর্টের একটি রায়ের। প্রাজ্ঞ বিচারকের এই পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে জায়মান রাজনীতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের সার্বিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। বিচারক যদিও তাঁর পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ‘কী করতে হবে’, অর্থাৎ এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় জীবনের ‘ক্ষতি’ নিরোধে আপাতত কর্তব্য কী, এই প্রশ্নের উত্তর উপস্থাপন করেছেন কি না, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনটিতে তার কোনও উল্লেখ নেই এবং উল্লেখের কোনও প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া আছে। এই ক্ষতি নিরোধে কী করতে হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিবিদের। এই কথাটা অবশ্যই রাজনীতিবিদদেরকে বলে দিতে হবে না বলেই মনে হয়। কারণ ক্ষতিটা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ওতপ্রোত। তাঁরাই বুঝবেন কী করে এবং কী করলে এবং কী না করলে দেশের ‘ক্ষতি’ হবে না, উপকার হবে।
এই উপমহাদেশের রাজনীতিবিদরা এক সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে দ্বিখ-িত করেছিলেন। তাঁর অনিবার্য ফলোদয় দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণক্ষয়সহ উদ্বাস্তু সমস্যার পাহাড় কাঁধে নিয়ে উপমহাদেশের মানুষকে কষ্টক্লান্ত পথ চলতে হচ্ছে এবং এখন বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের কাছে ‘ভারতপ্রীতি’ ও ‘ভারতভীতি’ নামক এই দু’টি রাজনীতিক প্রপঞ্চের (‘প্রপঞ্চ’ বলা ঠিক নয়, বলা উচিত ‘অধ্যাস’) কেরদারিসমা জনগণকে দেখিয়ে রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ রাজনীতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করছেন, যে-রাজনীতিক স্বার্থের মধ্যে জনগণের কোনও স্বার্থ নেই, বিশেষ বিশেষ রাজনীতিকের যেমন আছে। ১৯৪০-য়ের লাহোর প্রস্তাবে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বসিয়ে বারোশো মাইলের ব্যবধানে বিশাল ভারতকে রেখে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয় এবং আড়াই যুগ অতিবাহিত হতে না হতেই এই পাকিস্তান দ্বিখ-িত হয়ে পড়ে এবং ক্ষতির হিসেবে জমা পড়ে ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণ ও সাড়ে ৪ লক্ষ রমণীর নারীত্বের অপমান এবং তৎসঙ্গে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িকতার গুরুভার এখনও বহন করতে হচ্ছে উপমহাদেশকে এবং স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে হারাতে হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, দীর্ঘ দুই দশক বাংলাদেশকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয়েছে উন্নয়নের স্পর্শ থেকে। রাজনীতিক ক্ষতি আর কাকে বলে? বিচারকের পর্যবেক্ষণবাক্যে এই সব রাজনীতিক ক্ষতির কোনও উল্লেখ নেই, যে-ক্ষতিগুলো রাজনীতিকদের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অর্জিত’ হয়েছে। এই অর্জনের কোনও সীমা নেই। অনেক অনেক অর্জনের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো ব্যাপকাকারে দুর্নীতির পাকে রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ত হয়ে পড়া। যেমন জড়িয়ে পড়েছেন মন্ত্রী নাজমুল হুদা ও তাঁর স্ত্রী। ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের দায়ে বিচারক্রিয়া শেষে আদালত তাঁকে ৪ বছরের কারাদ- দিয়েছেন। এমনকি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি মামলায় বর্তমানে কারারুদ্ধ আছেন।
নাজমুল হুদার ঘুষগ্রহণের মামলার বৈচারিক পর্যবেক্ষণটি (সবটা পড়া থাকলে ভালো হতো। আপাতত সেটা হবার নয়।) বাংলাদেশের রাজনীতির একটি সার্বিক চিত্র কিংবা চরিত্র যাই বলি না কেন তোলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণকে উপেক্ষা করা বর্তমানের সরকার দলীয় রাজনীতিবিদদের কীছুতেই উচিত হবে না। বাংলাদেশে একটি টেকসই উন্নয়ন ও শান্তিসম্প্রীতির সামাজিক-রাজনীতিক অবস্থা, এই যাকে বলে বিশেষ করে আর্থসামাজিক বিন্যাস বিনির্মাণ করতে হলে কিংবা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলতে হলে এই পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিবিদদেরকে চলতে হবে, যে-করেই হোক। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে, যে-গুলো আমাদের দেশের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ অতিশয় সুকৌশলে সম্পন্ন করে থাকেন এবং ফলে ‘দেশের অর্থনীতি, জতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি’ হয়।