1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

একটি নির্জর কণ্ঠ : ইকবাল কাগজী

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৯

এই লেখাটির নাম ‘একটি বিজন কণ্ঠ’ হতে পারতো। কিন্তু যাঁকে নিয়ে লিখছি পরিচিত জনেরা তাঁকে বিজন কিংবা বিজনদা নামেই ডাকেন। তাঁর পিতার দেয়া নাম বিজন সেন রায়। আমার কেন জানি মনে হয়েছে ‘বিজন’ শব্দটার প্রয়োগ এখানে কৌতুকাবহের বিস্তার ঘটিয়ে সমগ্র বিষয়টার উপর একটা হালকা রঙের ছোপ ছড়িয়ে দেবে।
‘বিজন’ শব্দটার সঙ্গে জনতার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার প্রপঞ্চ বড়বেশি জড়িয়ে আছে। কিন্তু বিজন সেন রায়ের সম্পূর্ণ জীবনটাই জনতার সর্বাঙ্গীন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে জগৎসংসারের অলক্ষে ক্রমে ক্রমে এক সংগ্রামী আলেখ্যে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে, অন্যরকম আর অনবদ্য এক মহাজীবনের দিকে। যে-জীবন অমৃতস্পর্শী, যাকে বোধ করি বলা যায়, নির্জর জীবন। এই অন্যরকম নির্জর জীবনের যাত্রাপথে তার দৃপ্ত পদে হেঁটে চলায় তিনি ‘বিজন সেন’ আদপেই নন, সেখানে তিনি বড়বেশি ‘সজন সেন’। ‘জন’ কিংবা ‘জনতা’র সঙ্গে নিত্যদিন তাঁর বড়বেশি জড়াজড়ি ও সখ্য। হাজারজনের কথকতা নিয়ে তাঁর কারবার। সংবাদের শব্দে শব্দে, প্রতিবেদনের পঙ্ক্তির পদে পদে, ঘটনার ঘনঘটার বয়ানের অন্তরঙ্গ বাক্যের প্রতিটি বিস্তারে তিনি মিশে থাকেন হাজার জনের ভিড়ে। এই হাজার জনের ভিড়ে থেকেও তিনি তাঁর নামের মতোই বিজন। সেখানে তিনি আক্ষরিক অর্থেই নির্জন কিংবা বড়বেশি নিঃসঙ্গ। কেউ হয় তো বলবেন নিভৃত এক মানুষ। বোধ করি পৃথিবীর সব পত্রিকা সম্পাদকেরাই সম্পাদনার কাজের প্রকৃতির কারণেই এরকম একলা, যাকে বলে বিজনদার মতো বিজন। সম্পাদকেরা পৃথিবীর সকল মানুষকে নিয়ে কাজ করেন। মানুষের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, জীবনসংগ্রামের সকল অন্দিসন্ধি নিয়ে সম্পাদকের কারবার। এই কারণে লেখা শুরুর আগেই এই লেখার শিরোনাম করতে গিয়ে এমনকি ‘বিজন’ শব্দটার বিকল্প ‘নির্জন’ শব্দটাকে সমাদর করে এনে বসাতেও মনের সায় মিললো না।
বিজন সেন রায় একজন সম্পাদক। আমাদের সংস্কৃতিতে সম্পাদক অনেক প্রকারের। তার পূর্ণ ফিরিস্তি এখানে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। সম্পাদকদের মধ্যে সবচে নামডাকি হলেন ‘নীতির রাজা’ রাজনীতিক দলের সম্পাদকরা। বিজনদা কোনও রাজনীতিক দলের সম্পাদক নন। তিনি সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। সকলের পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার সাহস থাকে না এমনকি যোগ্যতাও। আগেই বলেছি, পত্রিকার সম্পাদকেরা হাজার জনের ভিড়ে থেকেও একা এক মানুষ থেকে যান, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তাঁরা এক নিভৃত ভুবনের মানুষ। সেখানে তাঁরা মানুষের ইতিহাসের লিপিকর। কেবল লেখেই চলেন। এই লেখার মহাকর্মযজ্ঞ চলে লেখক, সাংবাদিক, হকার ও মুদ্রাকর সকলকে নিয়ে। পাঠকেরা থাকেন নেপথ্যে। সম্পাদক এই ভিড়-দঙ্গলের মধ্যেও জীবন কাটিয়েও কীছুতেই দুকলা হতে পারেন না, তাঁর জীবন একলা জীবন। পত্রিকা সম্পাদকের এই প্রকৃতিগত নির্জনতাই সম্পাদকে করে তোলে নির্জর। যে-নির্জরতা সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র-রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে এক সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে সম্পাদককে ইতিহাসের খাতার পাতায় করে তোলে অমর, অজর কিংবা নির্জর। বিজন সেনের একটি কণ্ঠ আছে, যে-কণ্ঠটির প্রাতিষ্ঠনিক নাম দৈনিক সুনামকণ্ঠ। বিজন সেনের এই কণ্ঠটিই একটি নির্জর কণ্ঠ। সুনামগঞ্জের ইতিহাসে অমরত্বের অভিধা অর্জনকারী দৈনিক সুনামকণ্ঠ নামের নির্জর কণ্ঠটির ¯্রষ্টার নাম বিজন সেন রায়। কিন্তু কী করে? তারও একটি ইতিহাস আছে।
কেন জানি কোনও এক সময়ে বিজন সেন রায়ের খেয়াল হয়েছিল পত্রিকা বের করবেন। তাঁর এই খেয়ালটি হয়েছিল বলে বাঁচোয়া। সুনামগঞ্জের মানুষেরা একটি দৈনিক পেয়েছে। তা যেমনই হোক, মানের দিক থেকে একবারে ফেলনা কোনও পত্রিকা তো নয়। বরং কালের আখরে সুনামগঞ্জ নামক একটি জনপদের কথকতার কথাকার হয়ে থাকবে এই পত্রিকা। কিংবা বলা যায় সুনামগঞ্জের একটি বয়ান তৈরি করে চলেছে পত্রিকাটি, যে-বয়ানটি সুনামগঞ্জের সমাজকথার ইতিহাস পৌঁছে দেবে আগামী প্রজন্মের কাছে। পত্রিকা প্রকাশের খায়েশ মাথায় চাপার পর তা বাস্তবায়নের সেই ‘কোনও এক সময়’টি ছিল ২০০১ সালের ১৩ জুলাই। প্রতি মঙ্গলবার পত্রিকা বেরুত।
প্রতিদিন সুনামগঞ্জ সিলেটে পত্রিকা ছাপার কাজে দৌড়াদৌড়ি। পেস্টিং ও ছাপা কাজের দুটিই তখন করতে হতো সিলেট থেকে। সন্ধ্যারাতে লেখা নিয়ে সিলেট যাও, সিলেট গিয়ে পেস্টিং করো, তারপর ছাপার কাজ শেষ হলে পত্রিকা নিয়ে সুনামগঞ্জে ফেরত এসে বিলিব্যবস্থা। এই বিলিব্যবস্থার একটি অংশ খামের পীঠে প্রাপকের নাম লেখা ও টিকেট সাঁটা এবং ডাকে ফেলা। পত্রিকা ডাকে দেওয়ার আগের কাজটি দুই ছেলে ও তাঁরা স্বামীস্ত্রী একত্রে বসে করতেন। পত্রিকা বের করার এই ঝকমারি তাঁকে সইতে হয়েছে। বিনিময়ে সহ্য করতে হয়েছে কারো কারো টিটকারী।
একটি সত্য কথা এই যে, বিজন সেনের মতো বলতে গেলে কপর্দকহীনের পক্ষে পত্রিকা প্রকাশ আর গরিবের হাতি পোষার সখ সমান কথা। পত্রিকা প্রকাশ একটি অলাভজনক কাজ। কে না জানে, এটা করে প্রতিনিয়ত লাগাতার লোকসান গুনতে হবে। আগেই বলেছি খেয়ালের বশে বিজন সেন সেই লোকসানের কাজই হাতে নিলেন। কিছু লোকে টিটকারী দেবেই তো। পৌরবিপণির ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা ধার করে এক সংখ্যা পত্রিকা বের করেন। ক’দিন পর সেটা উশল করেন। সপ্তাহান্তে আবার টাকা ধার করেন, আবার ক’দিন পরে উশল করেন। তাঁর স্ত্রী’র বেতনের টাকা নিয়ে এসে পত্রিকার খরচ চালান।
কিছু লোকের টিটকারী অব্যাহত আছে। ক’দিন আর চালাতে পারবে। গরিবের ঘোড়া রোগে ধরেছে। এমনকি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে থাকলো কোনও কোনও ব্যক্তি কিংবা মহলের পক্ষ থেকে। পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হলো, একে একে তিনটি। এদিকে টিটকারী শোনতে শোনতে খেয়ালটা জিদে পরিণতি পেলো। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, পত্রিকা ছাড়বেন না। হাতে পত্রিকা প্রকাশের টাকা নেই। না থাক। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে বাসার জায়গা ছিল। ঝুঁকের বশে সেটা বিক্রি করে দিলেন। পত্রিকা প্রকাশ করবেনই। চললো তাঁর সংগ্রাম।
সুনামকণ্ঠের কার্যালয় ছিল পৌরবিপণির দু’তলায়। তখন সিলেট হতে পত্রিকা ছাপিয়ে আনতে হতো। প্রথম দিকে একাই পত্রিকার সব কাজ করতে হতো। কীছু দিন পরে পত্রিকার কাজে যোগ দিলেন রেজাউল করিম। তারপর অনেকেই পত্রিকাকে সহায়তা দিয়েছেন। সে সময় শাহার উদ্দিন আহমেদ, উজ্জ্বল মেহেদী, খলিল রহমান, তোবারক আলী, পুলিন রায়, শাহাব উদ্দিন আফিন্দী, আকরাম উদ্দিন, শামস শামীম, মাহমুদুর রহমান তারেক প্রমুখদের সহায়তা পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। আকরাম উদ্দিন আসার পর পেস্টিং করা নিয়ে সিলেট যাওয়া বন্ধ হলো। এখানেই তা করা সম্ভব হলো। পত্রিকায় লেখা দিয়ে সুনামকণ্ঠকে যাঁরা ধন্য করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম- মু. আব্দুর রহিম, সীতেশ চন্দ্র আচার্য্য, আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, তোবারক আলী, স্বপন কুমার দেব, ন্যাথানায়েল ই. ফেয়ারক্রস, পরিমল কান্তি দে, দিলীপ কুমার মজুমদার, বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, সুখেন্দু সেন, জাকির হোসেন, এনাম আহমদ প্রমুখ। তাঁদের প্রতি সুনামকণ্ঠের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ঢিমেতেতালা তালে চলতে চলতে পত্রিকাটি একসময় দৈনিক হলো। তারিখটি ২০১৫-র ১ জানুয়ারি। দৈনিক হওয়ার আগে পত্রিকাটি একজন কা-ারী পেল। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবী মো. জিয়াউল হক, যিনি দৈনিক সুনামকণ্ঠের উপদেষ্টাম-লীর সভাপতি। পত্রিকা ছাপানোর জন্য তিনি প্রেস বসালেন। মধুমিতা আবাসিক হোটেলের পূর্বপাশে প্রতিষ্ঠিত হল হক প্রিন্টিং প্রেস। ২০১৫ সালের ২ জানুয়ারি থেকে দৈনিক সুনামকণ্ঠ ছাপা হতে থাকলো এই প্রেস থেকেই। তারপর একে একে এলো ছাপার যাবতীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন সুনামগঞ্জ থেকেই রঙিন সুনামকণ্ঠ ছাপছে। সুনামকণ্ঠ’র পথচলা অব্যাহত থাকুক। ৫ম বর্ষে পদাপর্ণের এই শুভমুহূর্তে পত্রিকাটির সাথে জড়িত জন ও সকল শুভার্থীকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com