জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সুনামগঞ্জের আয়োজনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দিবস-২০১৮ উদযাপিত হয়ে গেলো, গত রোববার । জেলা প্রশাসকের উদ্ধৃতি উৎকীর্ণ করে দৈনিক সুনামকণ্ঠের সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে সুশীল সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ’। তিনি দুর্নীতির স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে যা বলেছেন, তার নিহিতার্থ হলো : আর্থিক উপটৌকন নিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, কাজ না করে চুপচাপ বসে থাকা, সেবাপ্রত্যাশীকে সেবাপ্রদান না করে অহেতুক হয়রানি করা, কোনও সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা না করা ইত্যাদি দুর্নীতির অংশ। অর্থাৎ দুর্নীতির সামগ্রিক রূপবৈচিত্র্যর বয়ান বিনির্মাণে তাঁর বক্তব্য প্রসারিত নয়, হয় তো ইচ্ছে করেই তিনি তাঁর বক্তব্যের অভিমুখ সেদিকে প্রলম্বিত করেননি। বুঝাই যায় তাঁর দুর্নীতি সংক্রান্ত বয়ানটি আমলাতান্ত্রিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত। যদিও তিনি মানুষের বিবেকের প্রশ্নটিকে প্রাসঙ্গিকভাবে উত্থাপন করেছেন।
কিন্তু কথা হলো : মানুষের ব্যক্তিতা, চরিত্র, চিন্তাচেতনা, ভালোমন্দবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ, নান্দনিকতা, মানবিকতা, ভালোবাসা, দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা প্রভৃতি আসমান থেকে পড়ে না, সমাজ থেকেই মানুষের মধ্যে চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। মানুষ একটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বিন্যাস বা আর্থব্যবস্থার প্রপঞ্চের (সামাজিক বাস্তবতা) ভেতরে জন্মে, বাঁচে এবং বেড়ে উঠে। এই বাঁচা ও বাড়ার সম্পূর্ণ বিষয়টি একটি মূর্তনির্দিষ্ট সামাজিকসম্পর্ক বা উৎপাদনসম্পর্কের সাপেক্ষে সম্পন্ন হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সংস্কৃতিতে আজ থেকে কয়েক দশক আগে চুরি কিংবা পরস্বাপহরণ প্রপঞ্চটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে জিয়াকর্তৃক প্রবসিত কোনও এক বাঙালি যখন কোনও এক উপজাতির বাগান থেকে আনারস চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল এবং ঘটনাচক্রে উপজাতিটি তা দেখে ফেলে, তখন আক্ষরিক অর্থেই ঘটনাটি কী উপজাতিটি তা বুঝতে পারছিল না, তার চেতনায় চুরি বিষয়ে কোনও পূর্বধারণা বা বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকার দরুণ। উপজাতীয় উৎপাদনসম্পর্কে চুরি প্রপঞ্চেটির তখনও উদ্ভব ঘটেনি। অর্থাৎ উপজাতি সংস্কৃতিতে চুরি ব্যপারটিই নেই। এমন একটি বর্ণনাা পাওয়া যায় কলাম লেখক সঞ্জিব দ্রং-এর লেখায়।
বলতে চাই, সমাজে বিদ্যমান অর্থনীতি সাপেক্ষে সামাজিক বাস্তবতা তৈরি হয় এবং সামাজিক বাস্তবতাই তৈরি করে সমাজমানসতা। এই সমাজমানসতারই অংশ ব্যক্তিতা বা ব্যক্তি মানুষের চরিত্র। বিশ্বে বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির রাজত্ব। মুক্তবাজার অর্থনীতি চলে মুনাফার উপর ভর করে। মুনাফা নেই মুক্তবাজার অর্থনীতি নেই। এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুভাব সব কীছুকেই পণ্য বানিয়ে ফেলা। যাবতীয় বস্তু ও চিন্তাচেতনা- এমন কি মানুষের বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যন্তÑ পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য হয়ে উঠে। সুতরাং একজন চাকুরিজীবী তাঁর সেবাকে পণ্য করে তোলেন এই সমাজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যানুসারেই, যদিও সেবাপ্রদানের বিপরীতে তিনি নির্ধারিত বেতন পেয়ে থাকেন। এখানে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিবেকের কোনও ভূমিকা নেই। কারণ কোনও বিশেষ সমাজে বিবেকের প্রপঞ্চটিও সমাজবাস্তবতা থেকেই নির্ধারিত হয়। আসল কথা সমাজের অর্থনীতিটাকে বদলে দিতে হবে। আর বদলাতে না পারলে বিবেকের উপর দুর্নীতি প্রতিরোধের ভার ছেড়ে দিয়ে কোনও ফায়দা নেই।