আজ থেকে ৪৬ বছর ১১ মাস ২ দিন আগে আমরা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলাম, দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ যুদ্ধ করে, ৩০ লক্ষ প্রাণোৎসর্গের বিনিময়ে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সদ্যস্বাধীন বিধ্বস্ত দেশটিকে ঠিকমতো একটু গুছিয়ে নেবার আগেই স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নিয়ে দেশটিকে একাত্তরপূর্ব সামাজিক-রাজনীতিক অবস্থায় নিয়ে যেতে দীর্ঘ দুই দশক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। পূর্বাবস্থায় অর্থাৎ পেছনের দিকে দেশেকে ফিরিয়ে নেবার বিভিন্ন কার্যক্রমের একটি ছিল, দেশের বধ্যভূমিগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, জাতির মনন থেকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নামস্মৃতিস্মারক মুছে দেওয়াসহ পুরো মুক্তিযুদ্ধকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবার সাংস্কৃতিক পরিম-ল তৈরি করা, এক কথায় যাকে বলে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাভাবিক সংগ্রামী ইতিহাসের বিকৃতি সাধন।
আলী আসগর একজন একাত্তরের যুদ্ধে শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা । তাঁর নাম শহীদ তালেব, জগৎজ্যোতি, গিয়াসের নামের সঙ্গে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ শহীদস্মৃতিফলকে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ তিনি তৎকালে সুনামগঞ্জ কলেজের একজন ছাত্র ছিলেন। কলেজকর্তৃপক্ষ এবার তাঁর নাম স্মৃতিফলকে যুক্ত করেছেন। তাঁর নামটি শহীদস্মৃতির ফলকে সংযুক্ত করতে সময়ক্ষেপণ ঘটেছে পুরো ৪৬ বছর। এইরকম দীর্ঘ সময়ব্যাপী শহীদের নাম বিস্মরণ প্রকৃতপ্রস্তাবে যে-কোনও জাতির পক্ষে ভীষণ লজ্জার। শহীদকে বিস্মরণের এই প্রবণতার জন্ম ১৯৭৫-এর রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে এবং তা প্রায় চারদশকব্যাপী প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির পুষ্টিসাধনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে আসছে, এখনও তার রেশ সম্পূর্ণ কাটেনি। সুনামগঞ্জ সদরের প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিটিআই) বিখ্যাত বধ্যভূমিটি নিশ্চিহ্ন করে বধ্যভূমির স্থানে একটি স্থাপনা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। যে-প্রচেষ্টাটি প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসস্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টার নামান্তর। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে দেওয়ার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকা- দেশে চলমান ছিল এবং এখনও আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইদানিং মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সে কুয়াশা কেটে যাচ্ছে।
এই তো গত কদিন আগে এতো দিন পরে, পিটিআইয়ের বধ্যভূমির স্থানটি সংরক্ষণার্থে চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্পেন একটি দেশ। সেখানে স্বৈরাচার ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর তল্পিবাহক শাসকরা ১৯৭৫ সালে ‘বিস্মৃতিচুক্তি আইন’ করে স্বৈরাচারবিরোধী মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষদের স্মৃতি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ২০০৭ সালে বামপন্থী রদরিকেস সাপাতোরোর সরকার এসে ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি আইন’ প্রণয়ন করে দেশটিকে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করে। আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে মুক্তির সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসংরক্ষণ সংক্রান্ত সকল কর্মকা- পরিচালনার জন্য সরকারের উচিত আরও বশি করে প্রণোদনা-সক্রিয়তা বাড়ানো এবং এই প্রক্রিয়াকে প্রবল ও বেগবান করা।