‘নতুন অধ্যক্ষ নীলিমা চন্দের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাসের মাথায় সেই গুরুতর অভিযোগগুলো নেই।’ সেই অভিযোগগুলো কী ছিল, কেন ছিল, কীভাবে ছিল, সেটা পরের কথা। আসল কথা এবং বড়ই আশ্চর্য কথা এবং চমকে উঠার কথা এবং বিশ্বাস হয় না ‘অসম্ভব’ কথা হলো, ‘গুরুতর অভিযোগগুলো নেই’। তা কোথায় গেল ? অভিযোগ তো না থাকার কথা নয়, এটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল কেউ তোলছে না, এটা তো হতে পারে না। অভিযোগের আঙ্গুল কি কাটা পড়ে গেলো? অবাক করা প্রশ্ন উঠতে পারে, এই অসম্ভব আবার কী করে সম্ভব ? আলাদিনের চেরাগ কি কেউ হাতে পেয়ে গেছে?
বাংলাদেশ একটা অভিযোগের দেশ, এখানে অভিযোগের জন্ম না হলে অবিশ্বাস্য ঠেকে, মনে হয় এটা অন্য কোনও দেশ। এখানে যে-কোনও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন না হলে সেটা আবার প্রতিষ্ঠান কীসের। এখানে প্রতিষ্ঠান মানেই নৈতিকতাবিবর্জিত একটি অনৈতিক কর্মক্রিয়ার অকুস্থল অর্থাৎ মিথ্যাচার, অনিয়ম, অন্যায়, আইন লঙ্ঘন, বেআইনি কাজ, দুর্নীতি, প্রতারণা, আত্মসাৎ, লোক ঠকানো, সন্ত্রাস, জঙ্গিত্ব ইত্যাদি যাবতীয় অপকর্ম করার মুক্তবাজার। ১৯৭৫-এর রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর এই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এককথায় সংস্কৃতির সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয় মদদে অনুপ্রবিষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, দেশটির উন্নয়নকে ব্যাহত করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে, শোষণের স্থায়িত্ব প্রলম্বিত করার লোভে। একাত্তরের পরাজিতরা জানতো, দুর্নীতিগ্রস্ত একটা দেশ কখনও উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে না। তারা তাই ক্ষমতা দখল করেই এদেশকে ইচ্ছা করেই দুনীতিগ্রস্ত করেছে, দেশকে একাত্তরপূর্ব পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে। সুতরাং আমরা এই চিন্তায় অভ্যস্ত হয়েই আছি, যিনিই অধ্যক্ষ হয়ে আসুন, তাতে কীছু যায় আসে না। অভিযোগ উঠার মতো কাজ তিনি করতেই থাকবেন। নীলিমা চন্দের আগে যেমন চলে এসেছে। দেশের আর্থসামাজিক বিন্যাস অন্তত তাই বলে। একটি দেশের আর্থব্যবস্থা যেখানে শোষণের মাত্রাকে অতিক্রম করে অবাধ লুটপাটের স্তরে গিয়ে উন্নীত হয় এবং সেটাকে দেশের চিন্তকদের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতার আর্থনীতিক রাজনীতি বলে অভিহিত করা হয়, সেখানে কোনও প্রতিষ্ঠানই কার্যত অনিয়ম-দুর্নীতির অশুভ স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে পারে না। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই অশুভের স্পর্শ বাঁচিয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠবে, আশা করা যায় না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠবেই এবং উঠাটাই স্বাভাবিক।
একসময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনাকে নস্যাৎ করার অভিপ্রায়ে ক্ষমতার প্রতিটি চেয়ার লুটেরা দুর্নীতিবাজদের হাতে নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এখন তার ধকল সইতে হচ্ছে দেশকে, সর্বস্তরে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে ন্যায়, নীতি, নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য। এ কথা তো মিথ্যা নয় যে, দুর্নীতির সমুদ্রে নিমজ্জিত এই দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আজ সৎ মানুষেরা অসৎ মানুষদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। সেই যুদ্ধের শরিক একজন যোদ্ধাকে অবশ্যই অভিযোগের উর্ধে উঠে সংশপ্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বোধ করি সুনামগঞ্জ সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এই প্রজাতির একজন, যাঁরা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত যোদ্ধাদের সহচর, যিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে অভিযোগের উর্ধে উত্তীর্ণ করার সংগ্রামে সংশপ্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যিনি প্রতিমুহূর্তের জন্য একজন সংশপ্তক শিক্ষক এবং প্রমাণ করেছেন ইচ্ছে করলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অভিযোগের উর্ধে উত্তীর্ণ করা যায়। তাঁকে ধন্যবাদ কিংবা অভিবাদন জানানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, আর তেমন কীছু করে তাঁকে ছোট করারও অধিকার আমাদের নেই। আমরা তাঁকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা দিলাম।