মো. আমিনুল ইসলাম ::
ক্লাস হয়না। আগের মতো আর ক্লাস করার জন্য বাসা থেকে চট-জলদি কলেজে ছুটতে হয়না শাপলাদের। বই নিয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনের বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এখন আর বই ই আনতে হয়না তাদের। এনে কি লাভ?। তিন বছর ধরে যে তাদের বিভাগটা বন্ধ হয়ে আছে। নেই শিক্ষক। নেই একটা ক্লাসেরও আশা। তাই বাধ্য হয়েই কলেজের বাইরে টাকা দিয়ে প্রাইভেটে করতে হচ্ছে রসায়নের ক্লাস। এ নিয়ে অনেকবার কলেজ প্রশাসনের কাছে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে হয়েছে মহিলা কলেজ ছাত্রী শাপলা আক্তার ও তার সহপাঠিদের। শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে কয়েকদফা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লেখালেখি হয়েছে কিন্তু তবুও তাদের একরকম অসহায়ত্বে পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। আশ্বাসের বাণিতে কেটে গেছে দিন থেকে মাস আর মাস থেকে বছর। শাপলারা যেনো আধুনিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন আর আলো ছড়াছড়ির দিনেও অনেকটাই অন্ধকারে।
নেই যাতায়াতের সমস্যা। নেই অনেকদূর পাড়ি দিয়ে কলেজে পৌঁছানোর মতো কোন ঝামেলাও। মধ্য শহরের ব্যস্ততম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েও এখানকার ছাত্রীদের যে সমস্যাটা জীবনের শুরুতেই ক্যারিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করছে সেটা হচ্ছে শিক্ষক সংকট। শহরের বাঁধনপাড়া রোডের এ কলেজটির চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ দির্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে আছে। আর এসব বিভাগে ভর্তি হওয়া ছাত্রীরা পার করছে তাদের জীবনের ‘সবচেয়ে সংকটময় দিনগুলো’। এমন কথাই জানিয়েছেন কলেজটির ছাত্রীরা।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের পাঠ সংক্রান্ত নানা জটিলতার বিষয়ে এ প্রতিবেদককে অভিযোগ করেন ছাত্রীরা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বিগত ২০১৩ ইংরেজি সাল পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির রসায়ণ বিভাগে কোন শিক্ষক নেই। এ বিভাগটির সব ধরণের পাঠ কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ থাকায় অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। হচ্ছেনা কোন প্র্যাক্টিক্যাল বা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জের ক্লাসও। এমন অবস্থা আরো তিন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের। সেগুলো হলো রাষ্ট্র বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান। এসব বিষয়ে বিগত ১ বছরের মধ্যে একটিও ক্লাস হয়নি বলে জানিয়েছেন ছাত্রীরা। তিন বছরের মধ্যে একবারও পরিসংখ্যানের পাঠ নেয়নি ছাত্রীরা। আর এসব ছাড়াও পরীক্ষা দিতে হয় আইসিটি বিষয়েও। যে বিভাগটিরও নেই কোন শিক্ষক।
ছাত্রীদের মতে গত কিছুদিন আগেও কলেজটির ইসলামের ইতিহাস, ইংরেজি ও ভূগোল বিভাগে একজনও শিক্ষক ছিলেন না। সে বিভাগগুলোও খালি ছিলো। নিয়মিত কলেজে আসলেও এসব বিভাগের পাঠকার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে লেখাপড়ার মূল শ্রোত থেকেই সরে পড়ছেন অনেকে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ কলেজটিতে ভর্তির জন্য হুমরি খেয়ে পরেন ছাত্রীরা। কিন্তু ভর্তি শেষে প্রতিষ্ঠানের এমন অচলাবস্থার কারণে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রীরা।
কলেজ প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা ও ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিয়করণ শেষে পাঠকার্যক্রম চালিয়ে আসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে লেখাপড়া করছে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ছাত্রী। বর্তমানে কলেজটির রয়েছে দুইটি ক্যাম্পাস। আর ২ ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন ১ জন নৈশ প্রহরি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরিত আবেদনে যে প্রয়োজন দেখানো হয়েছে তাতে কলেজটিতে ৫২ জন শিক্ষক দরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান হালচিত্রে যেখানে রয়েছে মাত্র কয়েকজন শিক্ষক। কলেজ প্রশাসনের আবেদনও ঝুলে আছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। একের পর এক চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ। কিন্তু এসব চিঠির কোন সদুত্তর মিলছে না।
অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এ প্রতিষ্ঠানটিতে চালু রয়েছে ডিগ্রি কোর্সে পাঠকার্যক্রম। তবে কলেজটির অফিসের কাজে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। যেখানে ১২ জন এমএলএসএস প্রয়োজন রয়েছে সেখানে কর্মরত রয়েছে ৬ জন। নেই কোন কম্পিউটার অপারেটরের সরকারি পদ। নেই হিসাব রক্ষক। বিপুল সংখ্যক ছাত্রীদের কলেজটির অফিসের কার্যক্রম চালু রেখেছেন মাত্র ২ জন অফিস স্টাফ। রয়েছে হোস্টেলের সিট সংকট। এর চেয়েও অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো কলেজটিতে কোন উপাধ্যক্ষ নেই।
কলেজের এমন অবস্থা নিয়ে এক ছাত্রী শাপলা আক্তার বলেন, ‘আমরা যখন ভর্তি হয়েছিলাম এর কিছুদিন কেটেছে দৌড়ঝাপ করে কলেজে আসায়, লেখাপড়া নিয়ে অনেক কিছুই ভাবতাম, কিন্তু সব এখন স্বপ্নের মতো লাগে, নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে এমন অবস্থা দেখবো সেটা কখনো চিন্তাও করিনি। সরকারের শিক্ষা নিয়ে এতো উন্নয়ন আর সাফল্যের কথাগুলো আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে কেবল কিসসা কাহিনীর মতোই, আমরা শিক্ষক সংকটের কারণে একটা ক্লাস করতে পারছি না, তিন বছর ধরে রসায়ণের ক্লাস হয়না, ক্লাস হয়না রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখানের, অনেক কলেজে একই বিষয়ের ২-৩ জন করে শিক্ষক থাকলেও আমাদের বেলায় ১ জনও নেই, বছরের পর বছর কাটছে, নেই সংকট নিরশনের কোনও উদ্যোগ, আমাদের ভবিষ্যৎ তাহলে কি? আমরা কি তবে ব্যর্থ? আর যদি তাই হয় তাহলে এটা কি জেলার দায়িত্বশীলদের উপর বর্তায় না?’।
আরেক ছাত্রী হ্যাপী আক্তার বলেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষাজীবনটা সুন্দর করে সাজাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কলেজের এ অবস্থার কারণে কোনভাবেই পারছি না, আমরা সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হয়েও শিক্ষক না থাকার কারণে বাইরে টাকা দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ গ্রহণ করছি, আমরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দায়িত্বশীলদের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি’।
আরো দুই ছাত্রী লাভলি আক্তার ও রুজিনা আক্তার জানান, কলেজে ক্লাস না করতে পারায় এ বিষয়টি নিয়ে অনেকবার কলেজ প্রশাসনের কাছে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন তারা, কিন্তু কলেজ প্রশাসনও রীতিমতো অসহায়, কারণ অফিস চালানোর মতোই লোকবল নেই তাদের, কলেজের হোস্টেলগুলোও নিরাপদ নয়, ২টি ক্যাম্পাসের জন্য একজন নৈশ প্রহরি সেটা শুনতেও খারাপ লাগে, ক্যাম্পাসে বিশুদ্ধ খাবার পানির কোন ব্যবস্থা নেই, ছাত্রীরা বাইরে থেকে পানি এনে পান করতে হচ্ছে, কলেজটির অবস্থা খুবই নাজুক’।
এ ব্যাপারে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর পরাগ কান্তি দেব বলেন, ‘আমি দুই বছর ধরে উপরে কেবল লিখেই যাচ্ছি, কোন সদুত্তর পাচ্ছি না, আমাদের ৪টি বিভাগ শিক্ষক না থাকার কারণে একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে, কোন ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না, ছাত্রীদের জন্য এটা অনেক বড় একটা সমস্যা, কিন্ত মন্ত্রণালয়কে বারবার জানোর পরেও কোন ব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেনি, আমরা যে কি ধরণের সমস্যার মধ্যে আছি সেটা কেবল আমরাই উপলব্ধি করছি প্রতিনিয়ত, এ বিষয়টি যারা জেলার দায়িত্বশীল রয়েছেন তাদেরকে অতি দ্রুত সময়ে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ বলেই মনে করি, কারণ এখানকার ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠা জরুরি’।