চক্র আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। চক্র ও চক্রমণ ব্যতীত বাঙালি জীবনের কথা এখন আর কল্পনাও করা যায় না। অর্থনীতি মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি। তাই প্রকৃতপ্রস্তাবে চক্র ও চক্রমণের প্রক্রিয়াটা প্রথমত শুরু হয় অর্থনীতিতে। অর্থনীতিতে চক্রমণ পূর্ণতা পেলেই ক্রমে অন্যান্য সামাজিক-রাজনীতিক অর্থাৎ এককথায় সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিম-লে সে-চক্রমণ বিস্তার লাভ করে। এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও এমন চক্রমণের দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। এই বিস্তৃতি ক্রমে দৈর্ঘ্যপ্রস্থে এবং গভীরে আরও বিস্তৃত হয় এবং সহজেই কোনও না কোনও একটি শ্রেণিচরিত্র অর্জন করে। চক্রমণের একটি হাতের কাছের উদাহরণ হলো, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনকে কেন্দ্র করে নৌকামালিক ও চালকদের চক্র। এই চক্রের একমাত্র লক্ষ্য পর্যটকদের পকেটের নগদ নারায়ণ অর্থাৎ টাকা। অল্প পরিশ্রমে এবং স্বল্প সময়ে বেশি করে টাকা কামাইয়ের প্রবণতায় প্রাণিত হয়ে এই চক্র টাঙ্গুয়া পর্যটনে আগত পর্যটকদের কাছ থেকে গলাকাটা দামে নৌকা ভাড়া আদায় করছে। নিরুপায় পর্যটকরা অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “টাঙ্গুয়ার হাওর : নৌ মালিক-চালকদের কাছে জিম্মি পর্যটকরা”। পত্রিকার বিবরণ থেকে জানা গেছে, দূর-দূরান্তের পর্যটকরা পর্যটনে এসে নৌকার মালিক-চালকদের কাছে মাত্রারিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে নাজেহাল হচ্ছেন। অতিসম্প্রতি ভাড়া বৃদ্ধি ঘটেছে আগেকার তুলনায় প্রায় তিনগুণেরও বেশি। নৌকার মালিক ও চালকরা সিন্ডিকেট করে পর্যটকদের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় যেমন একটি সামাজিক অন্যায়, তেমনি এটি পর্যটনশিল্প বিকাশের পথে একটি অন্তরায়ও বটে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নৈতিকতার নিরিখে যে-কোনও বিবেচনায় এ অন্যায় চলতে পারে না, লাভেরও একটা সীমা থাকা চাই। যেহেতু এর বিরুদ্ধে কেনও সামাজিক প্রতিরোধ উঠছে না, তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, সেই সুযোগে পর্যটকদের ঠকানোর দুরভিসন্ধিতে সীমালঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে এবং বুঝাই যাচ্ছে নৌ মালিক-চালকরা গলাকাটা দামে ভাড়া আদায়ে ভীষণ দড়। এর কি কোনও বিহিত করা যায় না? প্রশাসন কি অভ্যস্ত সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই কালাতিপাত করেই চলবে? সমাজ যেমন প্রতিরোধ তোলছে না তেমনি প্রশাসনও কোনও প্রতিবিহিতের ব্যবস্থা গড়ে তোলবে না? যদি না তোলে, তা হলে প্রশাসনের সামাজিক দায়িত্বটা রইলো কই? একটি পণ্যের দাম নির্ধারণে বিক্রেতার স্বাধীনতা কি এতোটাই লাগাম ছাড়া হবে? সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় থাকবে না বিদ্যমান ব্যবস্থায়, প্রশাসনের অধিকারে?
‘নৌমালিক-চালকদের কাছে জিম্মি পর্যটকরা’ টাঙ্গুয়া সংক্রান্ত এই সংবাদের পাশে টাঙ্গুয়া সংশ্লিষ্ট আর একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সে-সংবাদটির শিরোনাম, “পর্যটকবাহী নৌকায় ডাস্ট কালেক্টর বক্স দিবে জেলা পরিষদ”। সংবাদটি আমাদেরকে এই সংবাদ পরিবেশন করছে যে, আমাদের জেলা পরিষদ টাঙ্গুয়ার প্রতিবেশদোষণ নিরোধে ভাবিত। পর্যটকরা যে-ময়লাটা টাঙ্গুয়ায় ফেলে যাবেন তার অনিবার্য ক্ষতি থেকে টাঙ্গুয়াকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটি অবশ্যই একটি প্রসংশনীয় উদ্যোগ। জেলা পরিষদকে সে-জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের জেলা পরিষদ কি টাঙ্গুয়ার পর্যটকদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা দামে ভাড়া আদায়’-এর অন্যায় নিরোধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রাণিত হতে পারে না? অথবা আমাদের জেলা প্রশাসন কি এ ব্যাপারে, অর্থাৎ ভাড়ার দামের ব্যাপারে কোনও একটি সমোচিত ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হলে অসমীচীন কীছু একটা হয়ে যাবে, না কি সেটা প্রশাসনের এখতিয়ারের বাইরের কোনও একটি বিষয়? পর্যটকদের কাছ থেকে আদায়ের জন্য নৌকাভাড়ার একটি ‘উচিত মূল্য’ নির্ধারণ করার অধিকার কি জেলা প্রশাসন রাখে না? আমরা মনে করি পর্যটকদেরকে একটি উচিত মূল্যে নৌকাভাড়ার সুযোগ প্রদান করে টাঙ্গুয়া পর্যটনের ব্যবস্থা করা উচিত।