ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়েছে, সুরমা নদীর উপর আব্দুজ জহুর সেতু নির্মিত হয়েছে, তারপরও সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে উপজেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ যথাযথ অর্থে ততটা আশাপ্রদ নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাওরবেষ্টিত গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা এখনও নিতান্তই অপ্রতুল। দিরাই উপজেলা সদর থেকে মরমি কবি আব্দুল করিমের বাড়ি উজানধল যেতে যে পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে, তা বর্ষায় পানির তলে তলিয়ে যায়, সেটাকে আবুড়া (বর্ষার জলে তলিয়ে যায় না এমন) করে তৈরি করা সম্ভব হয়নি, হেমন্তের ছয় মাস এ সড়কে যান চলাচল করে মাত্র।
শেষ বিচারে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল এখনও দুর্গম। ‘বাইস্যায় নাও, এওতায় পাও’ ব্যবস্থা। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা সেই প্রাচীনকালের অবস্থার মধ্যেই পড়ে রয়েছে। সড়ক কিংবা জলপথে আধুনিক যানবাহনের প্রচলন এখনও সম্ভব হয়নি। জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের একটা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে জীবনমানের উন্নয়ন কীছুতেই সম্ভব নয়। ফলে বিশেষ করে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোর জীবনমান মান্ধাতার আমলের সমতলেই স্থির হয়ে আছে যুগের পর যুগ ধরে, এর স্থবিরতা কীছুতেই কাটতে চায় না। জলপথে যন্ত্রচালিত নৌকার প্রচলন ব্যতীত উল্লেখ করার মতো অন্যকোনও উন্নতি চিহ্ন নেই। এমতাবস্থায় হাওরের গ্রামগুলোতে অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা শিশুদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতকে দুর্গম করে রেখেছে, বিশেষ করে বর্ষায় ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে হাওরের উত্তাল ঢেউয়ে নৌকা ডুবির সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে শিশুশিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। এইসব প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে স্বাভাবিকভাবে হাওরাঞ্চলে শিক্ষার অগ্রগতির গতি মন্থর হয়ে আসে। তাছাড়া হাওরাঞ্চল এক ফসলি বোরো ধান চাষের অঞ্চল। এখানে চৈত্র্য মাসের শেষার্ধ থেকে শুরু করে পুরো বৈশাখ মাস ফসলকাটা ও ফসল গোলায় তোলার বিশালবিপুল কর্মযজ্ঞ চলে হাওর জুড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যাকে বলে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ফসল কাটা-মাড়াই-শুকানো-ঠামানোর বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। এ সময় শিশুরাও ব্যস্ত থাকে ফসল তোলার কাজে। তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। এদিক থেকে বিবেচনায় দেশে প্রচলিত শিক্ষাপঞ্জি (শিক্ষাক্যালেন্ডার) হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পক্ষে যথোপযুক্ত নয়। এ অঞ্চলের জন্য একটি আলাদা শিক্ষাপঞ্জির আবশ্যকতা দশক দুয়েক আগে থেকেই এখানকার রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীরা অনুভব করে আসছেন। সভাসমিতিতে এ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনাও কীছু কীছু হয়েছে।
গত রোববার (১৭ জুলাই ২০১৬) আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং মহিলা কলেজ উদ্বোধন করতে দিরাই এসেছিলেন। সেখানে তিনি হাওর এলাকার বর্ষায় চলাচলের সমস্যা, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সমস্যার কথা চিন্তা করে সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের জন্য পৃথক শিক্ষাক্যালেন্ডার প্রস্তুতের কাজ চলছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা আশা করছি অচিরেই সুনামগঞ্জ জেলার জন্য, বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের বা ভাটি বাংলার জন্য, নতুন শিক্ষাপঞ্জিটির প্রস্তুতির কাজ শেষ হবে এবং অচিরেই সেটা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।