গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, “সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক মৎস্যভা-ার রক্ষা করতে হবে Ñ এমপি মানিক।” বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে রাষ্ট্রচালকদের কথায় ও কাজে মিল থাকাটা এখনও সুনিশ্চিত নয়, যার ফলে অনেকেই অনেক কথা বলেন ও ভুলে যান। বিষয়টা অনেকটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, ভাষণ দেওয়ার সময় বলতে হয় বলে তাঁরা বলেন, শ্রোতার কাছে থেকে এক ধরনের বাহবা পাওয়ার আশায়ই বোধ করি, না হয় এমন কথা বলবেন কেন? তাঁরা বলেন এবং প্রকারান্তরে কথা কথাই থেকে যায় কাজের কাজ কীছুই হয় না।
কথা আর একজন বলেছিলেন এবং নিজের কথাকে কার্যকর করার জন্যে সংবিধানে মূল চারনীতির প্রথমটিই রেখেছিলেন সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রকে কায়েম করার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগেই তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছিল পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে দেশে সমাজতন্ত্রের উন্মেষকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিল। দেশের গরিব মানুষের উপকারে আসতে পারে এমন কোনও কার্যক্রমই পুঁজিবাদ গ্রহণ করেনি, এতোদিন পর্যন্ত। যাঁরা গরিব মানুষের কিংবা দেশের উন্নয়নের জন্য কথা বলেছেন তাঁদের অধিকাংশের কথাই, শেষ পর্যন্ত, কথার কথা বলে মর্যাদা লাভ করে তথাকথিত রাজনীতিক বক্তব্য হয়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, একদা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সকল স্বপ্নকে যেমন হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল পুঁজিবাদ এবং তৈরি করেছিল হাওয়াভবন নামের খাওয়াভবন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এমপি। তিনি গত শুক্রবার দুপুরে ছাতক উপজেলা অডিটরিয়ামে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে ছাতক মৎস্য বিভাগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে একটি উপকারী কথা বলেছেন। উপকারী এ জন্যে যে, তিনি যে কথাটি বলেছেন তা কার্যকর হলে দেশের, দশের উপকার হবে, কোনও একক ব্যক্তি বা কোনও প্রতিষ্ঠানের উপকার হবে না। কথাটি হলো, “সুনামগঞ্জে রয়েছে প্রাকৃতিক মৎস্য ভা-ার। এ মৎস্য ভা-ার থেকেই আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় অধিকাংশ মৎস্য সংগ্রহ করে থাকি। প্রাকৃতিক এ মৎস্য ভা-ার আমাদেরকে রক্ষা করে এর উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করতে হবে।” তাঁর এই কথা তিনি বা তাঁর সরকার কতোটুকু কার্যকর করতে পারবেন জানা নেই। সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই কথা অতীতের সকল সরকারই জানতেন, যেমন জানা ছিল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি সা¤্রাজ্যবাদী সরকারের। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এই সম্পদকে দেশ ও দশের উপকারে লাগাবার কোনও পরিকল্পনা কখনও গ্রহণ করা হয়নি কোনও সরকারের আমলেই। বরং টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে যতো কীছু হচ্ছে প্রকারান্তরে সেটা হাওর উন্নয়নের নামে হাওরের জীবনীশক্তির অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। অন্তত অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ের হাওর পরিপ্রেক্ষিতের বর্তমান অবস্থা তাই প্রতিপন্ন করে।
স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর সুনামগঞ্জ আব্দুজ জহুর সেতু পেয়েছে। যদিও এখানে মৎস্যসম্পদকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, হাওর উন্নয়নের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় কিংবা মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প অনায়াসে হতে পারতো। কিংবা এখানে প্রাপ্তব্য প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো অন্য কোনও কারখানা। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু কীছুই হয়নি। সুনামগঞ্জ এখনও রেলপথ পায়নি। আর এদিকে এমপি মানিক সুনামগঞ্জকে দেশের ‘প্রাকৃতিক মৎস্য ভা-ার’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এই ‘প্রাকৃতিক মৎস্য ভা-ার’কে রক্ষা করে এখানে মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেছেন। তাঁকে অফুরন্ত ধন্যবাদ।
কিন্তু লক্ষ প্রশ্নের মধ্যে প্রশ্ন আসলে একটাই, তাঁর কথাটি কি কার্যকর হবে, না কথার কথাই থেকে যাবে? বোধ করি এখনও তাঁর কথাটি কার্যকর হওয়ার অনিবার্য আর্থসামাজিক অবস্থা তৈরি হয়নি দেশে। যদিও জানা কথা, মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের কাছে ফিরে যেতেই হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। এবং দেশ সেই অবস্থা কিংবা আর্থব্যবস্থা তৈরির অপেক্ষায় আছে, যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে জাতির জনককে। দেশ অপেক্ষায় আছে যেটুকু বনভূমি পুঁজিবাদ ধ্বংস করেছে সেটুকুর পুনর্জনের। সেই সঙ্গে প্রতিটি হাওরের ক্ষেত, বিল, ডুবার পাড়ে থাকা কান্দা, জাঙ্গালে যে বনজঙ্গল, ঝোপ, ঝাড়, বৃক্ষ, গুল্মের সবুজ সমাহার ছিল, জলে ছিল জলজ উদ্ভিদ ও হরেক প্রজাতির প্রাণী, দেশ সেইসব হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।