এটা স্পষ্ট যে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে একটি মৃত্যু-উপত্যকা হিসেবে বিশ্বপরিসরে পরিচিত করে তোলার সচেতন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ইদানিংকার গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ বিবরণী পাঠ করে যে কোনও সাধারণ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এমনটাই মনে হতে পারে। আর কারও মনে এরকম ধারণার জন্ম হলে, তাঁকে দোষারূপ করারও বোধ করি কোনও সঙ্গত কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না। নির্বিরোধী একজন শিক্ষক, একজন সমকামীদের অধিকার বিষয়ক সাময়িকীর সম্পাদনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ কিংবা একজন লেখক-প্রকাশককে কেনও তিন-চারজন মিলে কুপিয়ে মেরে ফেলবে? এই প্রশ্নে তাড়িতজন তো ভাবতেই পারেন দেশকে অকারণে অস্থির করে তোলা হচ্ছে। দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নির্মল পরিবেশ তারা চায় না।
এই দেশ কবে-কখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে বা হতে শুরু করেছে, সেটা নির্ণয় করা একটি শ্রমসাধ্য গবেষণার বিষয়। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা-বিষয় এত স্পষ্ট ও উৎকটভাবে প্রকটিত হয়ে পড়েছে যে, নিরবচ্ছিন্ন ও নিবিড় গবেষণার প্রয়োজন হয় না, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিষদৃশ মোটাদাগে বা উৎকট আকারে বিশিষ্ট হয়ে থাকে। ক্ষমতার রাজনীতির এই কদর্যরূপ গণমানুষের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণকে দীর্ঘ করে।
১৯৭১-য়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে তোলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল এবং করায়ত্ব করার দ্বন্দ্বে নেমে সমগ্র দেশকে হত্যাযজ্ঞস্থলে পরিণত করে তোলতে কার্পণ্য করেনি তৎকালের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিক শক্তি। দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধ দেশকে একটি মৃত্যু-উপত্যকা করে তোলার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। স্বাধীনোত্তর কালেও স্বাধীন বাংলাদেশে মৃত্যু-উপত্যকায়নের রাজনীতি কখনই একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। সমাজের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা প্রতিক্রিয়াশীলরা সময়-সুযোগে বারবার তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে জেলে বন্দি-অবস্থায় হত্যা, সমগ্র দেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মহড়া ইত্যাদি অসংখ্য ঘটনা-সংঘটনের মাধ্যমে দেশকে অস্থির করে তোলে প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘বাংলাদেশ একটি মৃত্যু উপত্যকা’ এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করারই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা তারা চালিয়েছে। অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষ চলমান এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন। দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে। এখন পত্রিকায় পাঠ করতে হচ্ছে- “একই কায়দায় তিন দিনে চার খুন, বাসায় ঢুকে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা”।
গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতারোহণে ব্যর্থ রাজনীতিকশ্রেণি হত্যা-কূ-সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি অবলম্বন করে এই দেশে বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক শক্তিকে নির্মূল করার লক্ষ্যে এ দেশে ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের পতন নিশ্চিত করতে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মতো নারকীয় সহিংস ঘটনা সংঘটনসহ এন্তার হত্যা, গুম, নির্যাতন এখনও অব্যাহত আছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা-প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৩৫টিরও অধিক। তাছাড়া হাসিনাতনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ও অনুরূপ আক্রমণের নীলনকশার আওতায় আছেন, সম্প্রতি সে ষড়যন্ত্রও আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব ঘটনা বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন দেশের মানুষের মনে বিদ্যমান বর্তমান রাজনীতি নিয়ে অস্থিরতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেনÑ “মানুষের মধ্যে কোনো অস্থিরতা আছে বলে আমি মনে করি না। তবে অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে।”
আমরা চাই বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসুক। সকল রাজনীতিক শক্তি-প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অবলম্বন করুন। নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত, মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় পরিপক্ক হয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করুন। মনে রাখবেন, যে কোনও বিবেচনায় ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজনীতিকে রাজনীতি বলে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না, সেটা অপরাজনীতিই থেকে যায় যেটা কোনও অবস্থাতেই, কোনওভাবেই মানবসেবার কোনও পথ হতে পারে না। মানুষের সেবা করতে হলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতির কোনও বিকল্প নেই।