শামস শামীম ::
আন্তর্জাতিক রামসার সাইট হিসেবে খ্যাত দেশের অনন্য জলাভূমি টাঙ্গুয়ার ‘সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’-এ আর অর্থায়ন করতে চাচ্ছেনা দাতা সংস্থা সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড কোপারেশন (এসডিসি)। আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই হাওরটি সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ২০০৬ সাল থেকে এই সংস্থাটি সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাওরের জীব-বৈচিত্র রক্ষা ও রামসার নীতি বাস্তবায়নে যৌথভাবে অর্থায়ন করছিল। এসডিসি ও সরকারের যৌথ এই প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) মাঠ পর্যায়ে ‘সমাজ ভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল। তবে হাওররক্ষার নামে ওই সময়ে মাছ, গাছসহ হাওরের জীব-বৈচিত্র ধ্বংস হয়েছে বলে এলাকাবাসী ও সুধীজন অভিযোগ করেছেন। গত বুধবার বিকেলে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনেন সুধীজন।
আইইউসিএন সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হাওর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করে আইইউসিএন। গত বছরের জুন মাসে রক্ষণাবেক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়। ওই মেয়াদ শেষে আরো এক বছর মেয়াদ বাড়ায় দাতা সংস্থা এসডিসি। আগামী আগস্ট মাসে ওই মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ওই সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অফিস এবং কমিউনিটির লোকজন নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে হাওরটির দেখভালের দায়িত্ব হস্তান্তর করবে আইইউসিএন। পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘ ৯ বছরের অভিজ্ঞতা এবং আগামীতে হাওররক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো অবগত করবে আইইউসিএন।
দুটি উপজেলার ৮৮টি গ্রামবেষ্টিত ৯৭.২৯ বর্গ কি.মি. আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওর ইজারাদাররা বেপরোয়া আহরণের কারণে ১৯৯৯ সনে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরে ভূমি মন্ত্রণালয় পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হাওরটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে। ২০০৩ সাল থেকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসনকে নিয়ে ইজারাপ্রথা বাতিল করে ব্যবস্থাপনায় হাত দেয়। ২০০৬ সালে ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয় এসডিসি।
জানা গেছে, হাওরের হারানো জীব-বৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় জনগণকে সচেতন এবং সম্পদের উপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে কাজ শুরু করে আইইউসিএন। ইজারাদারের বদলে মাছ ও জীববৈচিত্র বৃদ্ধি করে স্থানীয় জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠাই ছিল সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মূল কথা। কিন্তু বাস্তবায়নের নামে সংশ্লিষ্টরা হাওরের জীববৈচিত্র ধ্বংস করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে হাওরে অবাধে মৎস্য নিধন হওয়ায় মাদার ফিশারিজ হিসেবে খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর এখন মাছশূন্য। গাছ-গাছালিও উজাড় হয়েছে। জানা গেছে, রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুটপাট এবং ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জহির উদ্দিন লুটপাটের এই ব্যবস্থাপনার বদলে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ফের বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন।
আইইউসিএন এর একটি সূত্র জানায়, সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনার নামে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রতিটি গ্রামের লোকজনদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করা হয়। ওই সমিতি গত ৯ বছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা সঞ্চয় করেছে। আইইউসিএন চলে গেলে ওই টাকা সমবায়ের মাধ্যমে এলাকার লোকদের মাধ্যমে ব্যবহার করা হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে সমিতির লোকজন এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে আইইউসিএন এর একটি সূত্র জানিয়েছে তারা ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিলেও সরকার ব্যবস্থাপনা টিকিতে রাখতে উদ্যোগ নিবে। এলক্ষ্যে কাজ চলছে বলে ওই সূত্র জানায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় না থাকলে হাওরের অবস্থা খারাপ হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
গত বুধবার সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ৩য় পর্যায়ের সামাজিক তহবিল ব্যবস্থাপনা (এসসিএম) হস্তান্তর এবং সংগঠনের ভবিষ্যৎ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সমালোচনার মুখে পড়ে আইইউসিএন।
মতবিনিময় সভায় সাংবাদিক বিন্দু তালুকদার বলেন, ব্যবস্থাপনার নামে গত ১৪ বছর ধরে টাঙ্গুয়ার জীব-বৈচিত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে রক্ষণাবেক্ষণে এসে নিজেরাই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এখন হাওরটি বিরান।
উদ্ভিদবৈচিত্র গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, ‘সকল রস সমাপ্ত করে রসকষহীন ছোবড়া রেখে চলে যাচ্ছে বাস্তবায়নকারীরা। কমিউনিটি বেজড ম্যানেজমেন্ট ছিল একটি গালভরা বুলি।’
টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের থিম্যাটিক কোঅর্ডিনেটর ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, গত বছর প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ১ বছর বাড়ানোর পর আগামী আগস্ট মাসে মেয়াদ শেষ হবে। সুইস এজেন্সি এসডিসি আর অর্থায়ন করবেনা বলে জানানোর পর হাওরটি সরকারের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগস্টের মধ্যেই জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অফিস এবং কমিউনিটির লোকদের কাছে ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করা হবে। আমরা সরকারকে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে হাওররক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো লিখিতভাবে অবগত করব।
প্রায় ৬০ হাজার জনগোষ্ঠীর বসবাস টাঙ্গুয়ার হাওরে। বেশির ভাগ মানুষই প্রকৃতিগতভাবে মৎস্যজীবী। বিস্তৃত এ হাওরে ৫২টি বিল, ১২০টি কান্দা-জাঙ্গাল রয়েছে। ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২১৯ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশীপাখি, ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৯ প্রজাতির সরিসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী বৈচিত্রময় করেছে টাঙ্গুয়াকে। তাছাড়া অসংখ্য স্থলজ, জলজ প্রাণী রয়েছে হাওরে, যা টাঙ্গুয়ার হাওরকে অনন্য করেছে। সারাদেশের সর্ববৃহৎ হিজল-কড়চের বাগ রয়েছে এ হাওরে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে বিবেচিত টাঙ্গুয়ার।