সমাজ এক চলিতকর্মের সমষ্টি। সমাজ চলে বিভিন্ন ও বহুমুখী নিতান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিংবা বিশাল বিশাল কর্মপ্রবাহের মহাযজ্ঞ সম্পাদন করে। রাষ্ট্র এই মহাকর্মযজ্ঞের পুরোহিত। পুরোহিত হিসেবে রাষ্ট্র এইসব শতসহ¯্র কর্মকা-ের মধ্যে আইনানুসারে বৈধ কিংবা অবৈধ কাজের তালিকা তৈরি করে। মাদক উৎপাদন, মাদক বিক্রি, মাদক ব্যবহার কোনওটাই রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ নয়। কিন্তু দেশে এই অবৈধ ব্যবসাটি ছিল এবং এখনও পর্যন্ত আছে। রাষ্ট্র এতোদিন পর্যন্ত এই ব্যবসাটিকে না-পারতে সহ্য করেছে। না-পারতে এজন্য যে, এই মাদকব্যবসা আন্তর্জাতিকভাবে এতোটাই শক্তিশালী যে, যে-কোনও অবস্থায় যে-কোনও রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে এই ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা মাদক ব্যবসায়ীদের আছে। এই ব্যবসা পুঁজিতান্ত্রিক নীতির অনুমোদনে প্রকৃতপ্রস্তাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি আর্থনীতিক ব্যবস্থা। বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থায় বোধ করি বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের এই উন্নতি কোনও কোনও শক্তিধর রাষ্ট্রকে মিত্র থেকে শত্রুতে পরিণত করেছে। এই সব শক্তিধরদের দিক থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নকে থামানোর একটাই আপাতত পথ খোলা আছে : বাংলাদেশের বিদ্যমান ও ভবিষ্যৎ তরুণ সমাজকে সম্পূর্ণ অক্ষম কিংবা মানসিক ও শারীরিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়া। এতোদিন চেষ্টা করা হয়েছে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে, ধর্মকে ব্যবহার করে। কিন্তু বিগত দশককাল ব্যাপী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাবস্থায় এইসব জঙ্গিবাদ ও ধর্মের অপব্যবহার কোনওটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাজে আসেনি, বাংলাদেশের উন্নয়নকে স্থবির করে দিতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ও মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি থামিয়ে দিতে পারেনি। এইসব উন্নয়ন থামিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে বিশ্বপুঁজির পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতবাবে এবার ব্যবহার করা হচ্ছে মাদককে। মাদকব্যবসা যে ছিল না এমন নয়। ছিল, কিন্তু তারও একটা মাত্রা ছিল। ব্যবসার মাত্রাটা এতোটা বাড়বাড়ন্ত ছিল না যে, সেটা দেশের যুবশক্তিকে ধ্বংস করে ফেলবে, অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়ে প্রকৃতপ্রস্তাবে দেশের উন্নতিকে থামিয়ে দেবে, এবং প্রকারান্তরে দেশটিকে একটি সা¤্রাজ্যবাদী পুঁজির বাজার, আসলে মাদকবাণিজ্যের স্বর্গভূমিতে পরিণত করবে। কিন্তু যখন অজপাড়গাঁয়ের ঝুপড়িঘরে ইয়াবা মেলে অনায়াসে, ছেলে মাকে দা দিয়ে কোপায় ইয়াবার টাকা না পেয়ে তখন, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সত্যিকার অর্থেই দেশটাকে মাদকবাণিজ্যের স্বর্গভূমিতে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্র এমতাবস্থায় কী করতে পারে? যখন উৎপাদন ও আমদানি কোনওটার নিয়ন্ত্রণই রাষ্ট্রের হাতে নেই। রাষ্ট্র কি হাত গুটিয়ে বসে থেকে নীরবদর্শক হয়ে দেশের যুবশক্তির ধ্বংস প্রত্যক্ষ করবে?
জানা কথা, কোনও দেশের যুবশক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়ার কাজটি অতি সহজে করা যায় মাদককে প্রয়োগ করে। এই মাদকব্যবসা সমাজবিরোধী কেবল নয়, এমনকি প্রকৃতপ্রস্তাবে একটা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ও বটে, অথচ ‘টপ সিক্রেট’ তকমা গায়ে এঁটে দাপটের সঙ্গে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কার্যকর এবং রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অবগতির ছত্রছায়ায় চলতে থাকবে, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, তারওপরে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি যুবসমাজকে পরিকল্পিত উপায়ে ধ্বংস করে চলবে, তা হতে পারে না কোনওক্রমেই।
বর্তমানে দেশের অন্দরবন্দর সর্বত্র অর্থাৎ হাটেঘাটে কিংবা মাঠেময়দানে, আলোচ্য বিষয় একটাই : মাদকবিরোধী অভিযান। গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “যতদিন মাদক পুরোপুরি নির্মূল না হবে, ততদিন অভিযান চলবে।” এই শিরোনামের কথাটি কোনও হালকা কথা নয়, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের অভিমতানুসারে এযাবৎকালে উচ্চারিত ওজনদার কথার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যসম্পন্ন কথা। এই তাৎপর্যের একটা আলাদা তাৎপর্য এই যে, আপাতত দেশের যুবশক্তিকে রক্ষা করতে হবে মাদকের হাত থেকে। কেউ কি এমন একটি দেশের কল্পনা করতে পারেন, যে-দেশের যুবশক্তি মাদকাসক্ত হয়ে উৎপাদনকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সে-দেশটা কেমন দেশ? সে-দেশের রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক অবস্থা কী? যেখানে সংস্কৃতি বলতে কেবল অবশিষ্ট থাকবে মাদক ও যৌনতায় বুঁদ হয়ে থাকা। বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে একটি বিষয় উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে, কোনও সাধারণের কথা নয়, কথাটি স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। অভিযানটিকে আরও এককাঠি প্রসারিত করা হয়েছে বলে মনে হলো যখন সংবাদ বেরুল, “৯০ভাগ স্কুলের পাশে সিগারেট বিক্রি ॥ ব্যবস্থা নেবে সরকার”। যারা বিচারবহির্ভূত হত্যার যুক্তি প্রদর্শন করে এই মাদকবিরোধী অভিযানের বিরোধিতা করেন, তাঁদেরকে অবশ্যই এই মুহূর্তে দেশের যুবশক্তিকে মাদক থেকে রক্ষায় কার্যকর মাদকবিরোধী অভিযানের বিকল্প নির্দেশ করতে হবে, অন্যথায় তাঁরা মাদকব্যবসা প্রতিরোধকরণে ব্যর্থতার একমাত্র অব্যর্থ ফল যুবশক্তি বিনাশের অবশ্যম্ভাবী ভয়ংকর পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।