ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকে সারা বছর। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এসব দুর্যোগ এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। তবে ইদানিং সামান্য বৃষ্টিপাত কিংবা ঝড়ো বাতাস হলেই ঘটছে বজ্রপাত। আর এতে দিন দিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বজ্রপাতের মতো মৌসুমি দুর্যোগে তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া খুবই মর্মান্তিক। গবেষকরা মনে করছেন বাংলাদেশে বজ্রপাত হওয়ার বড় কারণ হলোÑ বায়ু দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক টাওয়ার।
বিশেষজ্ঞদের মতেÑ বর্ষা মওসুমে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪০টি বজ্রপাত আঘাত হানে। সাধারণত আবহাওয়া পরিবর্তনে জলীয় বা®েপ কালো মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য আকাশে কালো মেঘ দেখলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এক গবেষণায় দেখা গেছেÑ আকাশে যেখানে মেঘ সৃষ্টি হয় তার ২৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার ফুট-এর মধ্যে বজ্রপাত ঘটে বেশি। আর প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার গতিতে বজ্র বিদ্যুৎ নিচে নেমে যায়। প্রতিটি বজ্রপাতে ৫০ হাজার এ¤িপয়ার বিদ্যুৎ শক্তি থাকে। যেখানে একটি বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ চলে গড়ে মাত্র ১৫ এ¤িপয়ারে। আর একটি বজ্র অনেক সময় ৩০ মিলিয়ন ভোল্ট নিয়ে আকাশে জ্বলে ওঠে। এই বিপুল পরিমাণ তাপসহ বজ্র মানুষের দেহে আঘাত লাগার সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়।
এ অবস্থায় বজ্রপাত থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখতে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সরকারের সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বজ্রপাত কেনো বাড়ছে আর বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল কেনো দীর্ঘতর হচ্ছে সে ব্যাপারে রয়েছে নানা জনের নানা মত। আবহাওয়াবিদরাও নানা কথা বলছেন। তবে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই যে বাড়ছে বজ্রপাত, সে বিষয়ে মোটামুটি সবাই একমত। পরিবেশ দূষণের পরিণামেই যে এমনটি হচ্ছে, তাতে কারো দ্বিমত নেই।
বিভিন্নর গবেষণায় দেখা যাচ্ছেÑ নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়া আর গাছ ধ্বংস হওয়ায় দেশে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষা আসার আগের এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ছে বাংলাদেশে। এতে এই সময়ে বাতাসে জলীয় বা®েপর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আদ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। গড় তাপমাত্রা বাড়ার আনুপাতিক হারে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি বজ্রপাত হওয়ার পাশাপাশি আগামীতে বাংলাদেশে এর পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে মৃত্যুর হারও বাড়বে জ্যামিতিক হারে। কারণ একসময় দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বড় বড় গাছ থাকত। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা খুব কমই থাকত। এখন সে চিত্র নেই বললেই চলে। মানুষ গাছপালা কেটে একদিকে পরিবেশ ধ্বংস করছে, অন্যদিকে বজ্রপাতের মত দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষার হাতিয়ারগুলোও নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে। প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টও বলছে, বাংলাদেশ বজ্রপাত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
তাই আমরা মনে করিÑ বজ্রপাতের মতো এমন জীবনসংহারী ঘটনায় আর নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। বজ্রপাত নিয়ে সরকারি পর্যায়ে গবেষণা কাজ পরিচালনার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ রোধ, বৃক্ষনিধন রোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী কর্মসূচি থাকা জরুরি। আর মানুষ একটু সচেতন হলেই বজ্রাঘাতে মৃত্যুর হার অনেক কমে আসবে। তাই বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে করণীয় স¤পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।