বলা হয় ভাষার অহঙ্কারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আঘাত হানলে মানুষ প্রত্যাঘাত করতে কখনও পিছপা হয় না। পৃথিবীতে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিসত্ত্বার আত্মজাগৃতির দিন। বাঙালি জাতি তার মনের ভেতরে মধ্যপ্রাচ্যীয় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার দাসত্ব শৃঙ্খল ছিন্ন করে দিয়েছিল এই দিনে। এই দিনে হাজার বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বাঙালি জাতিসত্ত্বা পৃথিবীর আকাশে তার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রের পতাকা উড্ডীন করেছিল। এই দিনে পৃথিবীর মানুষের কাছে বাঙালি একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল বাঙালি পরাভব মানে না। পৃথিবীতে মানব প্রজাতির জন্য এমন গৌরবের, এমন অহঙ্কারের দিন পৃথিবীতে একটাই আছে, তার নাম ভাষা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিশ্বভাষা দিবস। বাঙালি এর ¯্রষ্টা।
বাঙালি লড়াই করে বাঁচতে জানা এক জাতি। বাঙালি হাজার বছর ধরে হাজার হাজার শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে জিততে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতয়ার্ধে এসে পা রেখে ভাষাআন্দোলনে প্রমত্ত হয়ে প্রমাণ করেছে সে দুর্বার, দুর্দমণীয়। বাঙালিকে রুখা যায় না।
বাঙালি তার ভাষার জন্য বুকের শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে দিতে কার্পণ্য করে না। বাঙালি বাংলাকে ভীষণ ভালোবাসে। বাংলা তার মাটিমা, বাংলা তার ভাষামা। দুটির কোলেই সে সমভাবে লালিত ও পালিত। তাই সে কবি হয়ে উঠে বলেছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ পৃথিবীতে এ ভালোবাসার কোনও তুলনা হয় না। এ ভালোবাসায় মত্ত হয়ে বাঙালি একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ উৎসর্গ করেছে।
বাঙালির হাজার বছরের যাত্রাপথ কখনওই নিষ্কণ্টক ছিল না। কখনও জাতবদলের, কখনও ভাষাবদলের, কখনও সংস্কৃতিবদলের ষড়যন্ত্র করেছে বাঙালি জাতিসত্ত্বার শত্রুরা। এমনকি উপনিবেশ বানিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে বধ করতে উদ্যত হয়েছে হায়েনারা। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি বীরদর্পে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে নয় মাস। এতো কিছুর সঙ্গে সবচেয়ে খতরনাক আর্থনীতিক শোষণ তো অব্যাহত ছিলোই বরাবরের মতো। এখনও সেই অপশক্তি ও সে-অপশক্তির দালাল-দাস-দোসররা ঘাপটি মেরে আছে, ওৎ পেতে বসে আছে সমাজের স্তরে স্তরে। একাত্তরে পরাজিত অপশক্তি তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে অগ্রযাত্রার বাঁকে বাঁকে। তারা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করছে। শহীদদের অবমাননা করছে নানাভাবে। কিন্তু হাজার বৈরিতা, ষড়যন্ত্র, শোষণ, বঞ্চনার, নির্যাতনের প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে বাঙালির দুর্বার অভিযাত্রা অব্যাহত থাকবে। একুশের পথ ধরে বাঙালির পথচলা অব্যাহত থাকবেই। বিশ্বসেরা বাঙালিকে ঠেকাতে পারে এমন কোনও শক্তি নেই পৃথিবীতে। সাত মার্চের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ উচ্চারণ : ‘দাবায়ে রাখেতে পারবা না’ বাঙালির মনে আছে। বায়ান্নেও বাঙালির অন্তরের উচ্চারণ ছিল একটাই : ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এটাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উচ্চারণ।