জেলার হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও স্বপ্ন আবর্তিত হয় একটি মাত্র ফসল বোরোকে ঘিরে। কিন্তু প্রতি বছরই মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানীর ঘটনা ঘটে। কৃষকের চোখের সামনেই একে একে সোনার ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েন। বাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম- গাফিলতির কারণে এবং সঠিক সময়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই তা ভেঙে যায় বলে কৃষকরা যুগ যুগ ধরে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কৃষকের নিম্নকণ্ঠের সেই দাবি উপর তলায় পৌঁছেনা। তবে গতবার ফসলহানীর ঘটনায় কৃষকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ফলে জাতীয়ভাবেও হাওর এবার আলোচনায় ওঠে এসেছে। ফলে সরকার বাঁধরক্ষার নীতিমালা পরিবর্তনসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তবে এত কিছুর পরেও বিতর্ক ও অনিয়ম পিছু ছাড়ছেনা।
গত পরশু দিনের দৈনিক সুনামকণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন মারফতে জানা যায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সদর উপজেলা সভাপতি ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান দেখার হাওরের ফসল রক্ষার কথা বলে কৃষকের বরাদ্দ থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে ফসলরক্ষা বাঁধের টাকায় তৈরি করছেন একটি সড়ক ও শহর রক্ষা বাঁধ। একই উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নে জোয়ালভাঙ্গা হাওরের ফসল রক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ১৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন তিনি। নীতিমালা অনুযায়ী, হাওরের বাঁধ নির্মাণ মাঝ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে শেষ করার কথা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। কিন্তু তিনি এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করতে পারেননি। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ের এক মাস পেরোতে চললেও ৮৭০ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৭৫টির কাজ শুরু হয়েছে। যা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা জানিয়েছেন কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা।
সরকার প্রতিবছর ফসলরক্ষার বাঁধ সংস্কার বা নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। কিন্তু কিছু অসাধু কর্মকর্তার অনিয়ম-নয় ছয়ের কারণে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয় না। এমনও দেখা গেছে বাঁধে কোনো মাটিই ফেলা হয়নি অথবা নামমাত্র মাটি দেয়া হয়েছে। ফলে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনা ঘটে। দুর্ভোগ নেমে আসে কৃষকের জীবনে। দুর্ভোগ যেন স্থায়ী হয়েছে হাওরের কৃষকের নিয়তিতে।
ফসল রক্ষাসহ হাওরের বৃহত্তম জনবসতি বন্যার কবল থেকে রক্ষায় বাঁধের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক সময়ে এবং মানসম্মতভাবে বাঁধগুলো নির্মাণ করা খুবই জরুরি। তাই জেলার সবগুলো হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ যেন দ্রুত শুরু হয় ও কোনো ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো দরকার। বিভিন্ন পেশাজীবী ও কৃষক সংগঠন হাওরের বাঁধ নির্মাণে যেসব যুগোপযোগী দাবি জানিয়ে আসছে তা ভেবে দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
আমরা বাঁধ নির্মাণজতি অনিয়ম ত্রুটির কারণে ফসলহানীর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। তাই তোষণের প্রকল্প থেকে যেমন সড়ে আসতে হবে, তেমনি অনিয়ম ও দুর্নীতির দিকেও নজর রাখতে হবে। যাতে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়। কানামাছি খেলা নয় হাওর ভাটির লাখো কৃষকের ভাগ্য নিয়ে।
আমরা মনে করি হাওরবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার জন্য সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। তাই পাউবোসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি উপর মহল ও রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয়ে কৃষকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলাটা জরুরি।
যতই ভালো পরিকল্পনা হোক না কেন, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা যদি অসৎ হন, ‘মন্ত্রী’-‘এমপি’ কিংবা সরকারি কোনো ‘আমলা’কে খুশি করতে কৃষকদের বরাদ্দ থেকে হাওররক্ষা বাঁধের টাকা সড়ক রক্ষা প্রকল্পে ব্যবহার করেন তাহলে তা সাধারণ কৃষকের স্বার্থে চরম আঘাত হানবে। আমরা বলতে চাই এবার হাওররক্ষা বাঁধ নিয়ে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি চলবে না। নির্ধারিত সময়ে টেকসই ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।