হাওররক্ষা বাঁধের কাজে প্রতি বছর একই চিত্র আমরা লক্ষ করে থাকি। ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ে শুরু না হওয়ায় শেষ পর্যায়ে দায়সারাভাবে কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়। যার ফলে বাঁধগুলো টেকসই না হওয়াতে অতিবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় এগুলো ভেঙে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফসলরক্ষা বাঁধে অনিয়মের ফলে যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি আর পূরণ হয় না কৃষকের। ফসল ঘরে তোলতে না পারায় অনেক কৃষককে পথে বসতে হয়। কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয় সংশ্লিষ্টদের এই অনিয়ম-গাফিলতিতে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বেড়ে এ দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবন-জীবিকা বদলে দিচ্ছে। গত বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে ফসলহানির ঘটনার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন দেশের মানুষকে কতটুকু ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন না করা, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম বা অকাল বানে হাওরাঞ্চলের প্রায় শতভাগ ফসল ডুবে হাওরপাড়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলার পাশাপাশি স্থলজ ও জলজ প্রাণির খাদ্যচক্রে আঘাত হানে। হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ নষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়েছিল মৎস্যসম্পদ। দূষিত পানিতে খাবার খেয়ে দেখা দেয় হাঁসের মড়ক। একপর্যায়ে কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কাজের সন্ধানে শহরমুখী হয়। বিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীরা বেঁচে থাকার তাগিদে অভিভাবকদের সঙ্গে চলে যেতে হয়েছে শহরে। ফলে হাওরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় উদ্বেগজনক হারে উপস্থিতির সংখ্যা কমেছে।
হাওরে প্রতি বছরই দেরিতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফলে নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ শেষ না হওয়ায় হাওরের সোনার ফসল তলিয়ে যায়। এবারের বোরো ফসলরক্ষায় গত ১৫ ডিসেম্বর ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সবগুলো হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়নি। যা হাওরাঞ্চলের কৃষকদের ভাবিয়ে তোলছে। তাছাড়া যেসব স্থানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠিত হয়েছে সেখানে গেলবার ফসলহানির সঙ্গে জড়িতরা স্থান পাওয়ায় শঙ্কায় রয়েছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা।
চলতি বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলের কৃষকের ভাগ্যে কী আছে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। বিগত বছরগুলোয় কার্তিক মাসের মাঝামাঝি বা শেষদিকে হাওরের পানি নেমে গিয়ে বীজতলা ভেসে উঠত। কিন্তু এবছর কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস পেরিয়ে পৌষ মাসের তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও অধিকাংশ হাওরের পানি নামেনি। বীজতলা ভেসে না ওঠার কারণে বীজ রোপণ থেকে শুরু করে চারা রোপণ, ধান পাকা, ধান কাটা সবকিছুই বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সঠিক সময়ে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ায় এবারের বোরো ফসলকে আবারও হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠ’র একটি প্রতিবেদনের মারফতে জানা যায় শনিবার দুপুরে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি নলুয়ার হাওরের বাঁধ নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে বলেছেনÑ গতবছর বোরো ফসলডুবির কারণে কৃষকরা ফসল ঘরে তোলতে পারেননি। এবার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম, অবহেলা আর দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। তিনি আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাওরের বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করার নির্দেশ প্রদান করেন। হাওরের সোনার ফসল গুলায় তুলতে আমরা হাওরবাসী অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি’র নির্দেশের বাস্তবায়ন চাই।