অনাদিকাল থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপূজা করে আসছেন। দুর্গাপূজা এক সময় রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা করলেও বর্তমানে ধনী-গরিব সবার মহামিলনের ফলে সর্বজনীনরূপ নিয়েছে। দুর্গাপূজা একদিকে একক পরিবার প্রথা অন্যদিকে বিশ্ব পরিবারের একটি সুশৃঙ্খল প্রতিরূপ। সব ধরনের মুক্তি সংগ্রাম অত্যাচার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে শক্তি সাহসের প্রেরণা দান করেন দেবী দুর্গা। দুর্গোৎসব মৃত্যু ঘটায় মানবতাবিরোধী জাতিভেদ প্রথার।
‘দুর্গা’ শব্দের অর্থ ‘দুর্ভেদ্যা’। দুর্গ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো দুর্গা। দুর্গ হলো দুর্ভেদ্য তাই দুর্গা হলো দুর্ভেদ্যা। মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে নিলে রাজা ইন্দ্র দেবগণকে নিয়ে মহিষাসুরকে পরাজিত করতে পারেননি। ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্রাদি দেবগণের শরীর থেকে তেজ নির্গত হলে সব তেজ মিলিত হয়ে প্রজ্বলিত পর্বতের মতো দীপ্তি পেতে থাকে। পরে সে তেজোরাশি এক নারীরূপ ধারণ করেন যা দুর্গা নামে আখ্যায়িত হন। তিনিই মহিষাসুরকে বধ করেন। এজন্য তার এক নাম মহিষমর্দিনী। তিনি সব দেবের সম্মিলিত শক্তি, বিশ্বশক্তি। এ দুর্গার বহু নামের মধ্যে একটি পার্বতী, তিনি পবর্ত কন্যা, পর্বতবাসিনী পার্বতী। বাহন পশুরাজ সিংহ, দুপাশে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক। একদিকে জ্ঞানরূপ গণেশ, ঐশ্বর্য রূপালক্ষ্মী, অপরদিকে বিদ্যারূপিণী সরস্বতী, বীর্যরূপ কার্তিকের এর একটি গভীর তাৎপর্য আছে।
হিন্দু ধর্মের দুটি দিক আছে আধ্যাত্মিক এবং লৌকিক। আধ্যাত্মিক দিকটি ত্রিধারায় বিভক্ত ১. বৈদিক ২. দার্শনিক ৩. পৌরাণিক। লৌকিক দিকটি হলো দেবতাকে আত্মীয় জ্ঞানে স্নেহপ্রীতি ও ভক্তিরসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন। এ পর্যায়ে দেবী দুর্গা (কন্যারূপী উমা) স্বামী-পুত্র-কন্যাসহকারে ক’দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসেন। পূজা-পার্বণ উৎসবের আমেজে জনপদ আনন্দ লহরীতে মেতে ওঠেন। কয়েকটি দিন আমাদের প্রত্যেকের সংসারে যেন নেমে আসে স্বর্গ।
মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী শক্তিতে রূপান্তরিত করতে শাস্ত্রের নির্দিষ্ট উপায়ে পাঁচ দিনব্যাপী এই দুর্গাপূজায় সংযম, সংগ্রাম এবং কর্মচাঞ্চল্যের বিপুল আয়োজন। এই পূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাবের পূজা, ব্রহ্মার অনাবিল আনন্দ সাগরে ভক্তের সঙ্গে ভগবতীর এক মধুর সম্পর্ক।
পূজা অর্থ হলো পূর্ণতা অর্থাৎ প্রত্যাশা পূরণ। পূজা আনে পবিত্রতা। পূজায় আত্মসমর্পণ না করলে পূজার উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আত্মনিবেদনে মানুষ মনুষ্যত্বের পূর্ণতা লাভ করে। সংসার-সমাজ-দেশ তথা গণমানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করার মধ্যেই সত্যিকারের আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করতে হবে।
দুর্গোৎসবের এই শুভলগ্নে আমরা দীক্ষা নিই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অখ- মানবতাবাদের। মহাশক্তির আলোকে উজ্জ্বল আনন্দময় হয়ে উঠুক আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন। সেই সঙ্গে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হোক। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের কালো থাবা থেকে দূরে থাকুক। শান্তি বিরাজ করে সবখানে। সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা।