সামাজিক নানা বৈষম্য, অবহেলা ও চরম দারিদ্র্যের কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে শাল্লা উপজেলার বহুল আলোচিত ও কথিত চোরাপল্লী কামারগাঁওয়ের বাসিন্দারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারি প্রণোদনাসহ অবকাঠামো উন্নয়ন থেকেও বঞ্চিত তারা। কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে কথিত চোরের গ্রামের বাসিন্দারা মূল ¯্রােতে ফিরে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও সহায়তার হাত নিয়ে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। গ্রামবাসী যুগ যুগ ধরে অস্পৃশ্য হয়ে রয়েছেন। এ বিষয়ে গতকাল দৈনিক সুনামকণ্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সনের জাতীয় নির্বাচনে ভোটার তালিকায় পেশা ‘চোর’ উল্লেখ করে জাতীয়ভাবে আলোচনায় আসে কামারগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা। উপজেলার দুর্গম এই গ্রামটি চারদিকে হাওর বেষ্টিত। হেমন্তেও গ্রামে যাওয়ার সরাসরি কোন রাস্তা নেই। মুক্তিযুদ্ধে এই গ্রামবাসীর অসামান্য অবদান থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকেই গ্রামবাসী অবহেলিত। শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসহ নানা দিক থেকেই তারা পিছিয়ে আছে। গ্রামের সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। খুঁপড়ি ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে বাস করে একাধিক পরিবার। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের কোন ব্যবস্থা নেই গ্রামে। ভালো হওয়ার চেষ্টা থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তার অভাবে এখনো কিছু মানুষ হাতটানের অভ্যেস ছাড়তে পারেনি।
উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার গ্রামটিতে বর্তমানে গ্রামে ৩২টি খুঁপড়ি ঘরে প্রায় ১ হাজার মানুষের বাস। গ্রামে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত পুরনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নিয়মিত পাঠদান হয় না। শিক্ষকরা নিয়মিত আসেন না বিদ্যালয়ে। তাছাড়া অভাবের কারণে শিক্ষার্থীরাও আসেনা। গ্রামের গৃহহীন ৫টি পরিবার তিন রুমের স্কুলের দুটি রুমে বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ভিজিএফ-ভিজিডি বয়স্কভাতাসহ নানা প্রণোদনা দিলেও এই গ্রামের খুব কম মানুষই পায় সেই সুবিধা। সামাজিক ঘৃণা আর অবহেলার কারণে এই বৈষম্য চলছে যুগ যুগ ধরে। তাছাড়া চুরি দেবার পরও শান্তিতে থাকতে পারেনা তারা। আশপাশের এলাকায় কোন চুরির ঘটনা ঘটলে আসামি হয় এই গ্রামের পুরুষেরা। এমন অবস্থায় কোনো মানুষই ভাল থাকতে পারে না, ভালো নেই কামারগাঁও গ্রামের বাসিন্দারাও।
সুনামগঞ্জে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করে থাকে। তারা মুখে বলে এক কিন্তু কাজে দেখা যায় আরেক। এই কামারগাঁওবাসীর দুরবস্থা নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে তারা বঞ্চনার শিকার। কিন্তু তাদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসে না। এনজিওরা অন্যান্য এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রমের ‘জোয়ার’ বইয়ে দিলেও উপেক্ষিত থাকে কামারগাঁও। সরকারি সংস্থাগুলোর সুদৃষ্টি পড়েনা অবহেলিত গ্রামটির প্রতি। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে- কেন এই বৈষম্য? তাহলে কি আমরা ধরে নেব অবহেলা আর ঘৃণার কারণেই সংস্থাগুলো ওই গ্রামবাসীর উন্নয়নে কাজ করে না। এই আমাদের মানসিক দীনতা, যা কোনোভাবেই সুলক্ষণ নয়।
এই দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে হলে প্রতিটি মানুষকে উন্নয়নের মূল¯্রােতে সম্পৃক্ত করা যদি সরকারের লক্ষ্য হয় তাহলে কামারগাঁও অবহেলিত থাকলে চলবে না। ‘চোরের গ্রাম’ আখ্যা দিয়ে হাজারো মানুষকে উন্নয়নবঞ্চিত করা যেমন অমানবিক, তেমনি লজ্জার। আমরা বলতে চাই, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই সময় কামারগাঁওকে নিয়ে নতুন করে ভাবার। এই গ্রামের উন্নয়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সহায়তামূলক ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি মানুষ সরকারের উন্নয়নের সুফল ভোগ করুক – এটাই প্রত্যাশা।