১৫ আগস্ট, ২০১৭ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভোর রাতে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটা কোনো নিছক হত্যাকা- ছিল না। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সফল বাস্তবায়ন।
এই উপমহাদেশে ভারতবর্ষের সভ্যতার ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। খ্রিস্টপূর্ণ তিন হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের তীরে আর্যরা এক উন্নত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করত। আমাদের এই অঞ্চলে (পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ) সভ্যতার বিকাশ বিলম্বিত হয়। ভূ-প্রকৃতির গঠনপ্রণালী থেকে বোঝা যায় আমাদের এই অঞ্চল অধিকাংশই ছিল প্লাবনভূমি। উজানে হিমালয় পর্বতমালা ও নেপালের তরাই অঞ্চল থেকে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বিপুল জলরাশির সাথে নদীবিধৌত পলি প্রবাহিত হয়ে আমাদের এই অঞ্চল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের আকার ধারণ করেছে। সম্ভবত বিলম্বিত ভূমি গঠনের কারণেই আমাদের এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই সভ্যতার বিকাশও বিলম্বিত হয়। সভ্যতার বিকাশ একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের উদ্ভাবনী কর্মকা-, কীর্তিকলাপ ও মননশীল চিন্তাচেতনার উপর ভিত্তি করেই সভ্যতা তার আপন গতিতে এগিয়ে যায়।
আমাদের এই অঞ্চল হাজার বছর ধরে বহু রাজন্যবর্গের দ্বারা শাসিত হয়েছে। এদের মধ্যে গুপ্ত, মৌর্য, সেন, বলবন, সুলতান, মোঘল ও নবাব সিরাজদ্দৌলার শাসন উল্লেখযোগ্য। এরা ষড়যন্ত্র, রাজ্য দখল ও যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যেই অধিকাংশ সময় পার করেছেন। এইসব রাজন্যবর্গের সাথে সাধারণ মানুষের আয়-উন্নতি ও সুখ-দুঃখের নিবিড় সম্পর্ক ছিল না। কোনো জাতি গঠনে বা জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র বিকাশে এদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সাধারণ মানুষ ও তাদের শাসনকর্তা বা রাজন্যবর্গের প্রতি এক ধরনের নির্লিপ্ত মনোভাব পোষণ করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অবিভক্ত বাংলায় মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়। এই সময় জাতীয়তাবাদের সূচনা ও বিকাশের ধারাটি লক্ষ করা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে ধর্মীয় কুসংস্কার পরিহার, নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংস্কার ও মানুষের পশ্চাৎপদতা দূর করার লক্ষ্যে বেশ কয়েজন বিশিষ্ট ব্যক্তি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবান মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার আমির আলী, সৈয়দ আহমদ, খাজা সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা প্রত্যেকেই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদের বিকাশে, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সমাজ সংস্কারের এই কাজের মধ্যে তাদের মনোজগতে একটি মৌলিক ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। তারা এই বিশাল কর্মকাণ্ডে ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কে সমভাবে ধারণ করতে পারেন নি। হিন্দু ও মুসলিম উভয় নেতৃত্বের মধ্যেই সচেতন বা অসচেতনভাবেই সাম্প্রদায়িকতার বীজটি প্রোথিত ছিল। যার ফলে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, হিন্দু-মুসলিম বিরূপ সম্পর্ক, অনেক অসংগতি ও বহুমাত্রিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে ভ্রান্ত দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল। এদিকে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা তরুণ যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় চলে আসেন। জন্মলগ্ন থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অসম অর্থনীতি ছাড়াও জাতিগত, প্রকৃতিগত, সংস্কৃতিগত এবং ইতিহাসের স্বতন্ত্র সত্তাগুলি ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করে সামনে চলে আসে। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে তাদের মধ্যে তীব্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। যার মূল কথা ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। শেখ মুজিব তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, মানুষকে ভালাবাসার জন্য একটি মহৎপ্রাণ হৃদয়, সীমাহীন ত্যাগ ও আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৭১ সালে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এভাবেই ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে সঠিক অবস্থান ও নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবুর হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
জাতীয় ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় গতানুগতিক পুরাতন ব্যবস্থা বহাল রাখেন। ১৯১৭ সালে লেনিন সশস্ত্র বিপ্লব করে রাশিয়ায় জার রাজতন্ত্রকে পরাজিত করেন। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীনে বিপ্লব সম্পন্ন হয়। হো চি মিন-এর নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রাম সম্পন্ন হয়। রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনামে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হয়। বিপ্লবী চেতনায় শানিত মুক্তি সংগ্রামীরা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরে দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনযন্ত্রে বহাল থাকে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত, সুবিধাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণাপুষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এরকম একটা পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা ভিতরে ভিতরে সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠে। আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর তাবৎ দরিদ্র ও শোষিত মানুষের পক্ষ নেয়ায় সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির মোড়লরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এদের সম্মিলত ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার চেতনা ও প্রগতির অব্যাহত ধারাটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। অপব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে ধর্ম আশ্রিত সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে প্রগতির বিরুদ্ধে ভ্রান্তভাবে দেশকে পরিচালিত করা হয়। নতুন প্রজন্মকে পরিকল্পিতভাবে মানসিকভাবে বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত ও বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয়।
দেশের গরিব, দুঃখী ও প্রান্তিক জনসাধারণকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে একটি আলোকিত আধুনিক মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ অবধি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আসুন, সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার এই অব্যাহত প্রচেষ্টা ও লড়াইয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকারাবদ্ধ হই।
[লেখক : সাবেক প্রচার সম্পাদক, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ]