সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
বক্সিং রিংয়ে খুব কম সময়েই হারতে দেখা গেছে তাকে। তবে জীবন যুদ্ধে শেষ অবধি হেরে গেলেন কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। শনিবার সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের ফোনিক্স শহরের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই কিংবদন্তি। দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট, পারকিনসন্সসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন মোহাম্মদ আলী। শ্বাসকষ্টের সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। শেষ অবধি বাড়ি ফেরা হলো না তার; চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
আলীর পরিবার জানিয়েছে, তার বাসস্থান লুইসভিলেতে দাফন করা হবে এই কিংবদন্তিকে।
মুষ্টিযুদ্ধে খুব কমই হেরেছেন মোহাম্মদ আলী। পেশাদার লড়াইয়ে ৬১টি খেলার মধ্যে ৫৬ বারই জিতেছেন তিনি। এর মধ্যে ৩৭টি লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে নকআউট করেছেন তিনি। নিজে একবারও নকডআউট হননি। ১৯৮১ সালে অবসর গ্রহণ করেন আলী।
১৯৭৮ সালে আমেরিকান এ মুষ্টিযোদ্ধা বাংলাদেশ সফরেও এসেছিলেন। বাংলাদেশি মানুষের কাছে তিনি অতিপরিচিত মানুষ ছিলেন।
অবসর নেওয়ার ৩ বছর পর থেকেই পারকিনসন্স রোগে ভুগছিলেন আলী। গত কয়েক বছর ধরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। তার কিছুদিন পরই ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মূত্রঘটিত সংক্রমণ হওয়ায় হাসপাতালে যেতে হয়।
শুরুর জীবনে তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে। তবে ১৯৬৪ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর সেই নাম পাল্টে তিনি হয়ে যান মোহাম্মদ আলী। সময়ের আবর্তনে মোহাম্মদ আলী নামটি হয়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে ভালবাসা-শ্রদ্ধার এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। আলীর মৃত্যুতে তাই শোকাহত পুরো বিশ্বই।
যেভাবে শুরু : ১৯৪২ সালে ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্ম হয়েছিল মোহাম্মদ আলীর। পিতার নামের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছিল ক্যাসিয়াস মারসিলাস ক্লে জুনিয়র। ১২ বছর বয়সে এক বাইসাইকেল চুরির ঘটনায় বক্সিংয়ের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয় মোহাম্মদ আলীর। তার বাইসাইকেলটি চুরি করেছিল যে চোর, তাকে বেদম প্রহার করতে চেয়েছিলেন বালক মোহাম্মদ আলী। সেই ইচ্ছে তিনি প্রকাশ করেছিলেন লুইসভিলের পুলিশ কর্মকর্তা জো ই মার্টিনের কাছে। পেশায় পুলিশ হলেও মার্টিন কিন্তু ছিলেন সেখানকার স্থানীয় বক্সিং কোচ। মোহাম্মদ আলীকে তিনি পরামর্শ দেন, চোরকে পেটাতে হলে অবশ্যই তাকে ঘুষি মারাটা ভালো করে শিখতে হবে। সেই থেকে শুরু মোহাম্মদ আলী ও বক্সিংয়ের যোগসূত্র।
সেই কথার প্রেক্ষিতে পরদিনই মোহাম্মদ আলী বক্সিং শেখা শুরু করেন মার্টিনের কাছে। সে সময় তিনি (মার্টিন) তাকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে প্রজাপতির মতো নেচে নেচে আর মৌমাছির মতো হুল ফুটিয়ে লড়াই করতে হয়।
১৯৫৪ সালে অ্যামেচার (শৌখিন) বক্সিংয়ে অভিষেক হয়েছিল মোহাম্মদ আলীর।
কিংবদন্তি হয়ে উঠা : ১৯৬০ সালে রোমে অলি¤িপকে স্বর্ণ পদক জয়ের পর থেকেই মূলত মোহাম্মদ আলীর উত্থান শুরু। ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ওই বছরই নিজ ধর্ম পাল্টে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। সেই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী নামটি ধারণ করেন।
আলী প্রথম বিশ্ব খেতাব জেতেন ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়েই। পরে তিনি প্রথম বক্সার হিসেবে ৩ বার বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা জেতেন।
‘শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ’ খেতাব পাওয়া আলী শুধু বক্সিং রিংয়েই দাপিয়ে বেড়াননি, আগে-পরে ম্যাচ নিয়ে কথাবার্তাতেও ছিলেন পটু।
তিনি ছিলেন একজন মানবাধিকার কর্মীও। যে কারণেই মূলত খেলা ও জাতীয়তার সীমা ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তার বক্সিং লাইসেন্স ও বিশ্বচ্যা¤িপয়নের খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাকে পাঁচ বছর কারাদন্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু শেষ অবধি আপিলের প্রেক্ষিতে আদালতের রায় আলীর পক্ষেই যায়।
এরপর অনেক বছর আলী লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেননি। নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে সেই নিষেধাজ্ঞাই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে আলীকে আরও জনপ্রিয় করে তুলে। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই আলী রিংয়ে ফিরে বক্সিং ইতিহাসের তিনটি বিখ্যাত লড়াইয়ের অংশীদার হন।
আলী ক্যারিয়ারের শেষ খেলাটি খেলেন ১৯৮১ সালে কানাডার ট্রেভর বেরবিকের বিরুদ্ধে। সে খেলায় হারের পরই অবসরে যান তিনি। তারপরই দেখা দিতে শুরু করে পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ। সঙ্গে একে একে আরও অনেক রোগই আক্রমণ করে তাকে। যার শেষ পরিণত হলো না ফেরার দেশে এই কিংবদন্তি মানুষটির চলে যাওয়ায়।