বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে বাস মিনিবাস মালিক-শ্রমিকদের হাতে ‘জিম্মি’ জেলার মানুষ। সরকারি নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে ভাড়া বাড়ানো, লক্কর-ঝক্কর মেয়াদোত্তীর্ণ বাসে অতিরিক্ত সিট বসানো, যাত্রী পরিবহনে নিত্য হয়রানি, বিরতিহীন পরিবহনের নাম দিয়ে যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা করাসহ যাত্রীরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন।
আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সভাসহ বিভিন্ন ফোরামে যাত্রী হয়রানির এসব দাবি নিয়মিত উত্থাপন হচ্ছে। এসব সভায় নিয়মিত উন্নত বাস সার্ভিসের দাবি জানানো হলেও প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি ‘সচেতন সুনামগঞ্জবাসী’র ব্যানারে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে বিআরটিসি বাস চালু এবং উন্নত বাস সার্ভিসে যাত্রীসেবা চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি ও প্রতিবাদ কর্মর্সূচি পালনের পর জেলার সর্বস্তরের জনতা এ দাবির প্রতি সংহতি জানাচ্ছেন। তারাও এই দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বিআরটিসি বাস চালুসহ উন্নত বাস সার্ভিসের দাবি জানিয়ে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে যাত্রী হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানান।
সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি ও সুধীজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে প্রায় সহ¯্রাধিক বাস-মিনিবাস যাতায়াত করতো। ওই সময় থেকে পার্শ্ববর্তী সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারে উন্নত বাস সার্ভিস চালু হলেও রহস্যজনক কারণে সুনামগঞ্জে লক্কর-ঝক্কর বাস দিয়েই যাত্রীসেবা চলছে। অভিযোগ রয়েছে ওই সময় বৃহত্তর সিলেটে আধুনিক বাস নামানোর পর সেসব এলাকার মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-মিনিবাস যাত্রী পরিবহনের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে সুনামগঞ্জে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে ২০০৪ সনের পর সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে কোন নতুন বাস নামানো হয়নি। বরং ওই সময়ে সিলেট জেলার অন্য তিন উপজেলায় যাত্রীদের দাবির প্রেক্ষিতে আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এভাবে সুনামগঞ্জের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা নি¤œমানের পরিবহনে যাতায়াতে বাধ্য করছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে সুনামগঞ্জ জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতি, সুনামগঞ্জ মিনিবাস মালিক সমিতি, সিলেট মোটর বাস মালিক সমিতি, সিলেট মিনিবাস মালিক সমিতি নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া গুনেই যাতায়াত করছেন জেলাবাসী।
সুনামগঞ্জ বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ আলফাত স্কয়ার (ট্রাফিক পয়েন্ট) থেকে সিলেটের আম্বরখানা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৬৯ কিলোমিটার। এ সড়কে বাস চলাচল করে মল্লিকপুর-কুমারগাঁও পর্যন্ত। যার দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এই দূরত্বপথে মালিক সমিতি সরকারি নিয়মে ৮৭ টাকা ভাড়া আদায় করার কথা থাকলেও তারা ১০০ টাকা ভাড়া আদায় করছে। শুধু ভাড়া বাড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা প্রায় প্রতিটি মিনিবাসে ড্রাইভারসহ ৩০টি আসনের সঙ্গে আরো ৫টি আসন বাড়িয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। জানা গেছে, গত বছর ফিটনেসবিহীন পুরনো গাড়ি থেকে অতিরিক্ত সিট কমানোর কথা বলে সরকারের অনুমতি না নিয়েই ১০০টাকা ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন তারা। সম্প্রতি পেট্রোল ডিজেলের দাম কমার পরও ভাড়া কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, গত বছরের ৩০ মার্চ সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সভায় সিট বাড়ানোর ছুতোয় অযৌক্তিক ভাড়া বাড়ানোর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে পুরনো গাড়ি থেকে অতিরিক্ত সিট তুলে নেওয়ার অভিযান পরিচালনার আহ্বান জানানো হয়। এই সিদ্ধান্ত সুনামগঞ্জ-সিলেট মালিক সমিতির লোকজনকে জানানোর পরও তারা সরকারি আদেশের তোয়াক্কাই করেননি।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সিলেট পরিবহন মালিক সমিতির সংশ্লিষ্টরা চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি জরুরি সভা ডেকে রেজুলেশন করে ৩০টি সিটের সঙ্গে অতিরিক্ত আরো ৫টি সিট যুক্ত করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন।
এদিকে সুনামগঞ্জ মালিক সমিতির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তারা নতুন বাস নামানোর পক্ষে থাকলেও সিলেট সমিতির বাধার কারণে নতুন বাস চালু করতে পারছেন না। তবে সিলেট সমিতির এই বাধার বিরুদ্ধে তারা কোন প্রতিবাদ তো দূরের কথা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরেও কোন অভিযোগ করেননি বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা বাস মিনিবাস ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক বলেন, সিএনজি লেগুনার কারণে বাস যাত্রী কমেছে। এজন্য বাস মালিকরা নতুন বাস নামাতে আগ্রহী নন। তবে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে আমাদের সমিতি বাস ভাড়া গতকাল বুধবার থেকে ১০ টাকা কমিয়েছে। পাশাপাশি বিরতিহীন গাড়ির সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে এগিয়ে আসলেও অন্য সমিতিগুলো এতে আগ্রহী নয় বলে তিনি জানান।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ পরিমল কান্তি দে বলেন, সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কই যাত্রী পরিবহনে উন্নত সেবা থেকে পিছিয়ে আছে। যাত্রীরা একদিকে হয়রানি হচ্ছে, অন্যদিকে নি¤œমানের বাসে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত চলছে। উন্নত বাস সার্ভিসের দাবিতে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তা অব্যাহত রাখা উচিত। আমি এ নিয়ে কোন ফোরামে সুযোগ পেলেই কথা বলব।
সুনামগঞ্জ বিআরটি-এর মোটরযান পরিদর্শক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, সিলেট বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে উন্নত বাস সার্ভিস থাকলেও সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে নেই। নাগরিকরা উন্নত বাস সার্ভিস চালুর দাবিতে যে স্মারকলিপি দিয়েছেন আমরা তা পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠিয়েছি। সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কে পুরনো বাসসহ প্রতিটি বাসে অতিরিক্ত সিট এবং অযৌক্তিক ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।