শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলার বিস্তৃত হাওরপাড়ের দুর্গত মানুষের অন্তরে যখন কেবল হাহাকার, ফসল হারিয়ে লক্ষ লক্ষ কৃষকের চোখে যখন শুধু অন্ধকার, মাছের মড়ক, হাঁসের মড়ক, হাওরের জীব বৈচিত্র্য যখন হুমকির সম্মুখীন, ডাঙ্গার বাতাসেও সম্ভাব্য অ্যামোনিয়া প্রভাবিত দুর্গন্ধে শংকিত শহরের মানুষ তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মহাজ্ঞানী সচিবের উদ্ভট ছাগলতত্ত্ব এ অঞ্চলের মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। দু’দিন ধরে যার প্রতিফলন ঘটছে স্থানীয় সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা না গেলে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় না, মাননীয় মন্ত্রী এবং আইন প্রণেতা সাংসদগণের সম্মুখে এমন অমানবিক মনগড়া আইনের ধারার উদ্ধৃতি দিয়েই কেবল ক্ষান্ত দিলেন না বীর বাহাদুর সচিব, যারা দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে, তাদের জ্ঞানহীন অর্থাৎ মূর্খ বলারও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলেন। কীসের দুর্গত এলাকা, যেখানে একটি ছাগলও মারা যায়নি, এমন সদম্ভ আস্ফালনও করেছেন এই তত্ত্ববিদ।
“সুনামগঞ্জের জ্ঞানহীন মূর্খ চাষাভূষারা কী করিয়া এমন জটিল তত্ত্ব বুঝিবে হে, প্রজাতন্ত্রের বেতনধারী কর্মচারী? যেখানে মানুষই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে, দুর্গতির অন্ত নাই সেখানে দুর্গত এলাকা ঘোষণার জন্য একটি ছাগলকে অবশ্যই আগে মরিতে হইবে অতঃপর সুনামগঞ্জের আনুমানিক ২৫ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে কমপক্ষে তের লক্ষ মরিতে হইবে। তাহা হইলেই কেবল সদাশয় সচিবের বিবেচনায়, দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যাইতে পারে, তাহার আগে নয়।”
বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই প্রাণের টানে ছুটে এসেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ব্যথিত হয়েছেন। ফসল রক্ষা, হাওর রক্ষার স্থায়ী সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যগণকে পরামর্শ দিয়েছেন, এ নিয়ে সংসদে জোরেশোরে কথা বলার জন্য। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কান্নাকাটি না করলে ¯েœহময়ী মায়ের দুধও পাওয়া যায় না।
বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দুর্গত মানুষ সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানাতেই পারে। এতে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হচ্ছে এমন ধারণা পোষণ করা অবান্তর। ঘোষণা দেয়া না দেয়া সরকারের উপরই নির্ভর করে। দুর্গত এলাকা ঘোষণা না করে সরকার যদি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম হয়ে মানুষের দুর্গতি লাঘব করতে পারে তাতেও আপত্তি জানাবো কেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা এবং বিপর্যয়ের গভীরতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় অন্যান্য যৌক্তিক দাবির পাশাপাশি দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিটিও কোনভাবেই অযৌক্তিক নয়। আর নয় বলেই স্থানীয় সাংসদ পীর মিসবাহ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, আইনজীবী সমিতিসহ অনেক সংগঠন, সুজনের স¤পাদক ড.বদিউল আলম মজুমদার বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্তসহ অন্যান্য দাবি দাওয়ার পাশাপাশি দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিও উত্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রপতি পুত্র সাংসদ রেজওয়ান আহমদ তৌফিক একই সঙ্গে সমগ্র হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমলাতন্ত্রে বৃটিশ, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। পূর্ব-পাকিস্তান প্রায়ই বন্যাক্রান্ত হয়ে ফসলহানি, প্রাণহানির কারণে পর্যুদস্ত হলেও কেন্দ্র থেকে কখনই এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হতো না। দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হলে প্রদেশকে অতিরিক্ত সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে এই বিবেচনায় বাঙালির ন্যায্য সকল দাবির মত এই দাবিও অগ্রাহ্য হয়ে যেতো। সে নীতির ধারাবাহিকতা বলবৎ রয়েছে এযাবৎ। যৌক্তিকতা থাকলেও স্বাধীন দেশে এ দাবি সর্বদাই অগ্রাহ্য হয়েছে। সচিবের বাচালতায় তেমন বিস্মিত হইনি। তবে যখন দেখি সুনামগঞ্জেরই কোন কোন রাজনীতিক যারা মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন, অসহায় মানুষের পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন তারাই কোটারী স্বার্থে গিরগিটির মত রং পরিবর্তন করে সচিবের ছাগলতত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমিক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তখন এদের জন্য কেবল করুণাই হয়।
[লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া]