বিশেষ প্রতিনিধি ::
রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, হাওরে যখন এবার দুর্যোগ শুরু হয় তখন প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি হাওরের লোক। আমার হাওরের মানুষ এখন ফসল বাঁচানো নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমার এই উদ্বেগের বিষয়টি লক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, আপনার হাওরের কোন লোক না খেয়ে মারা যাবে না। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে ইকোনোমিক জোন করেন, শিল্প কারখানা করেন। আগামী ২০ এপ্রিল আবারও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলব। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গেও দুর্গত হাওরবাসী নিয়ে কথা বলবো। তিনি আগামী ২ মে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশনে হাওরের সকল সাংসদের এই বিষয় নিয়ে কথা বলার আহ্বান জানান। আগামী ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত ফেয়ারপ্রাইসে চাল বিক্রি চালু রাখা ও ওএমএসের ডিলার ও বরাদ্দ বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সুধীজনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, আমি কৃষকের সন্তান, হাওরের ক্ষয়ক্ষতি আমি গভীরভাবে উপলদ্ধি করি। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে কৃষকের কান্না শুরু হলে এর শেষ হয় কিশোরগঞ্জে গিয়ে। সুনামগঞ্জের মানুষের দুর্যোগে আমাকে কেউ দাওয়াত করে আনেনি। এ অঞ্চলের দুর্ভোগের কথা উপলদ্ধি করে আমি নিজ তাগিদে সুনামগঞ্জে এসেছি এবং স্বচক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর সমূহ পরিদর্শন করেছি।
সুধীজনের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জে তাঁর স্মৃতিকাতরতা নিয়ে বলেন, সুনামগঞ্জের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। ১৯৭১ সনে মে মাসের প্রথম দিকে এসেছিলাম। তখন দুর্যোগের সময় এসেছিলাম। এবারও দুর্যোগের সময় এসেছি। আশা করি এবারের দাঁড়ানোটা নিরর্থক হবে না। একটা কিছু হবেই। দেশকে স্বাধীন করতে একাত্তরে এ অঞ্চলে যুদ্ধ করতে এসে বিফল হইনি। হাওরের মানুষের এ মহাদুর্যোগে বিফল হব না ইনশাল্লাহ।
তবে স্থানীয় সাংসদদের আগামী সংসদ অধিবেশনে দুর্গত হাওর নিয়ে সোচ্চার বক্তব্য রাখার আহ্বান জানান। সংসদে কথা বলেই দাবি আদায় করতে হবে বলে সাংসদের উদ্দেশে তিনি বলেন।
হাওরের ফসলহানি বিষয়ে রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, হাওর এলাকার নদীর গভীরতা কমে গেছে। নদীর নাব্যতা কমায় পানি দ্রুত হাওরে নেমে আসে। এখন নদীর গভীরতার চেয়ে হাওরের গভীরতা বেশি। হাওরাঞ্চলকে বাঁচানোর জন্য অবশ্যই সরকারকে নদী খনন করতে হবে। নদীর পানিধারণ ক্ষমতা না বাড়িয়ে বাঁধ উঁচু করলেও কোন লাভ হবে না। ফসল রক্ষা হবে না।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ হাওরবেষ্টিত সবকটি জেলার বড় বড় নদী ভরাট হয়ে গেছে। আকস্মিক বা অকাল বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে পাহাড় থেকে প্রবাহিত নদী থেকে শুরু করে ভৈরববাজার পর্যন্ত সবকটি নদীগুলোকে ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে খনন করতে হবে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এ অঞ্চলের জন্য নদী খননের কোন বিকল্প নেই।
তিনি ফসলহারা কৃষকের জন্য আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত ফেয়ারপ্রাইস মূল্যে চাল বিক্রির আহ্বান জানান। পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে এটা চালুসহ তা বৃদ্ধির কথাও বলেন।
তিনি বলেন, এ জেলার কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে, এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত ওএমএস’র চাল বিতরণ চালু রাখা প্রয়োজন। কৃষক ও সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে হাওর সংক্রান্ত সকল সমস্যা দূর করা হবে। যেসব মন্ত্রণালয় আছে, যে যে কাজ করে সেই মন্ত্রণালয়কে সে কাজ করার জন্য ব্যবস্থা করব। হাওরের ইকোনোমিক জোন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। হাওরের সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত হবোই হবো।
তিনি বলেন, ‘হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ মাটি দিয়ে তৈরি করলে এমন হবেই। মাটির বাঁধ ব্লক দিয়ে ঢেকে দিলে মাটির বাঁধও রক্ষা হবে। ডুবে গেলে ডুবন্ত বাঁধ হবে। আবার এ বাঁধও রক্ষা করা যাবে না। যারা নৌকা দিয়ে হাওরে চলাফেরা করেন, তাঁরা ফাড়ি পথে যাওয়ার জন্য মাটির বাঁধও কেটে দেন, আবার ব্লকের বাঁধও কেটে দেবেন। কারণ এটা ভাটির মানুষের একটা অভ্যাস। আবার জমির আইল যুগের পর যুগ টিকে থাকে। কিন্তু মাটির বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাবে না। এখন নদীর গভীরতা কমে গেছে। এ হিসেবে হাওরের জমিতে গভীরতা বেশি। যে কারণে বৃষ্টির পানিতেও ফসল ডোবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে আবার ডুবেও যায়। আগে তেমন বন্যা বা অকাল বন্যা হতো না। আমি সর্বপ্রথম ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করেছি। এখন সারাদেশে ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ চলছে।
তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। আপনারা সবাই বলেছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, সুশীল সমাজের লোকজন বলেছেন, শিক্ষাবিদ বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, সাংবাদিক বলেছেন। আপনারাই দুর্নীতির কথা বলেছেন। তাহলে দুর্নীতি করেছে কে? আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে দুর্নীতিকে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতি বছর বন্যা হয়। মাটির বাঁধ ভেঙে যায়। এখন হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তা করতে হবে। জিকে টেক্সটাইল দিয়ে বর্ষায় হাওরের বাঁধ ঢেকে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাওরের তুলনামূলক নিচু জায়গায় আমি মাটির বাঁধে বিশ্বাস করিনা। মাটির বাঁধে দুর্নীতি হবেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সচেতন মানুষ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সম্পৃক্ততা থাকার পরও কিভাবে দুর্নীতি হয় এই প্রশ্ন রাখেন তিনি। তিনি বর্ষায় চলাচলের জন্য বাঁধ ভাঙার সময় জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই সময় বাঁধ রক্ষার স্বার্থে আমরা যেন ‘পাতারে’ না চলি।
প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ফেসবুকে ছবি ছেড়ে কাজ হবেনা। জনগণ এসব দেখেনা। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মন থেকে কাজ করতে হবে।
হওরাঞ্চলবাসীর পিছিয়ে থাকার দিকে ইঙ্গিত করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমরা হাওরের মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত। আমার কিশোরগঞ্জের সমস্যা আর সুনামগঞ্জের সমস্যা একই সমস্যা। আমি হাওরের সমস্যা বুঝি। সুনামগঞ্জের কৃষকের কান্না আমার এলাকা থেকেও শোনা যায়।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যের বেশির ভাগ জুড়েই ছিল এই অঞ্চলে থেকে তার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের বিষয়। তিনি ৫ নং সেক্টরের টেকেরঘাট ও বালাট সাব সেক্টরের নানা জায়গার স্মৃতিচারণ করেন। একাত্তরের সহযোদ্ধাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মতবিনিময় সভা শুরু হয়। এরপর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন মাওলানা তাজুল ইসলাম, পবিত্র গীতাপাঠ করেন নেজারত ডেপুটি কালেক্টর অন্জন দাস, পবিত্র বাইবেল পাঠ করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শুভন রামসা এবং পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সম্রাট খীসা।
এর আগে দুপুরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে হেলিকপ্টারযোগে সুনামগঞ্জ এসে পৌঁছান। পরে স্থানীয় সার্কিট হাউসে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। বিকাল সোয়া ৩টায় রাষ্ট্রপতি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মববিনিময় সভায় মিলিত হন এবং সুনামগঞ্জে বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত হন। সন্ধ্যা ৬টায় তিনি জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত এক বৈঠকে মিলিত হন। শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে মতবিনিময় সভায় যোগদানের পূর্বে সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
আজ মঙ্গলবার সকালে আবারো হেলিকপ্টার যোগে সুনামগঞ্জের সদর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দেখার হাওর, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর, দিরাই-শাল্লার বিভিন্ন হাওর এবং হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।