মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি হাওরাঞ্চলে জন্ম নেয়া ভাটিবাংলার অকৃত্রিম বন্ধু, হাওরবাসীর একান্ত স্বজন। ভরা বর্ষায় হাওরের জলকেলি, মৌসুমী ফসলের সুমধুর গন্ধ, এদিক-ওদিক মাছের অবাধ বিচরণ, জল-জোছনার আলো-আভায় বেড়ে ওঠা সৎ-নিরহঙ্কার, স্পষ্টবাদী-বলিষ্ঠ এক কৃতী পুরুষ। আপনি আমাদের গর্ব ও প্রেরণার উৎস। হাওর সম্রাজ্ঞী সুনামগঞ্জের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই শ্রদ্ধা শুভেচ্ছা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি এমন এক সময় সুনামগঞ্জে আসছেন, যখন আমাদের ফিবছরের লালিত স্বপ্ন অকাল বানে ভেসে গেছে। কৃষকের ঘরে ঘরে হাহাকার-আহাজারি। একমাত্র বোরো ধানকে ঘিরেই আমরা স্বপ্নের জাল বুনি, আমাদের বেঁচে থাকা-বেড়ে ওঠা, আমাদের পেটের যোগান যাবতীয় আদান-প্রদান, সম্পর্ক স্থাপনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও একমাত্র অবলম্বন এই বৈশাখী ফসল। আমাদের গবাদি পশুরও নির্ভরতা এখানেই। আপনি তার সবই জানেন এবং বুঝেন। কারণ, আপনি এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে মিলে-মিশে, আনন্দ-বেদনার সাথী হয়ে আজ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন – এ কারো করুণা নয়, এ আপনার প্রাপ্য, আমাদের প্রাপ্য। নিশ্চয়ই পার্লামেন্ট গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণে আপনার জন্য এ সুযোগ করে দিয়ে আমাদের প্রত্যাশার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েছে, আমরা সকল সম্মানীয় পার্লামেন্টারিয়ান ও পদ্ধতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নামক এক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান আমাদের হাওরের ফসল রক্ষায় ‘বাঁধ’ নির্মাণের কাজ করে থাকে। প্রতি বছর বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে। দশ-বিশ কোটি থেকে বেড়ে এবার প্রায় সত্তর কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃতির একমাত্র ব্যতিক্রমী আশির্বাদ ছাড়া কোন বৎসরই এ ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন অর্থ কৃষকের কান্না থামাতে পারেনা, বরং গুনে গুনে তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাউবো’র দায়িত্বশীলদের যোগসাজশে পিআইসি ও ঠিকাদার সিন্ডিকেট সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে হাওরবাসী তথা কৃষকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সুনামগঞ্জের ৪২টি ফসলরক্ষা বাঁধের বিপরীতে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু ফসল রক্ষা পায়নি, সমূলে বিনাশ হয়েছে। প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর বোরো ফসলের মধ্যে কম-বেশি দুই লক্ষ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ কুড়ি অবস্থায় বাঁধের তলে চাপা পড়েছে। সরকারি হিসেবের সাথে বাস্তবতার মিল অবশ্য খুঁজে পাওয়া ভার।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আজ সুনামগঞ্জের মানুষ প্রতিবাদমুখর। তারা রাস্তায় নেমেছে। এখানে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই। নেই কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। স্লোগান উঠেছে ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’। এ নামে একটি নাগরিক সংগঠনও আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা এ অব্যবস্থার আশু প্রতিকার চায়। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, ঠিকাদারি পদ্ধতি বাতিল, বালি-পলিতে ভরে যাওয়া খাল-বিল-নদী খনন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ, তাদের ঋণ মওকুফ ও নতুন ঋণ প্রদান, রেশনিং প্রথা চালু ইত্যাদি তাদের সার্বজনীন দাবি। আপনি ষোল কোটি মানুষের অভিভাবক, মাটি ও মানুষের মহান নেতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন অনুমোদনকারী। আপনার কাছে এ পরিস্থিতির সবিস্তার বর্ণনা অতিকথন ও ধৃষ্টতা বলে মনে করি। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেউ কেউ প্রকৃত অবস্থার ব্যতিক্রমী বর্ণনা দিয়েছেন বলে অনেকে শুনেছেন। আপনি এসেছেন, হাওর এলাকা পরিদর্শন করবেন, স্বচক্ষে বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করবেন বলে জানি। আপনার সুচিন্তিত পদক্ষেপ হাওরবাসীদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে আমাদের দাবিসমূহ যথার্থ মূল্যায়ন পাবে বলে প্রত্যাশা করি।
[নির্মল ভট্টাচার্য, উন্নয়ন সংগঠক, সুনামগঞ্জ।]